দৃষ্টিহীন ফয়সালের মাসে আয় আড়াই লাখ

দৃষ্টিহীনতা অন্তরায় না হয়ে শক্তি হয়েছে তাঁর জীবনে। বাড়িতে কাজে মগ্ন ফয়সাল মোহাম্মদ। সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসায়
ছবি: সৌরভ দাশ

ফয়সাল মোহাম্মদ যখন চোখের দৃষ্টি হারান, তখন তাঁর বয়স মাত্র ৯ মাস। দুনিয়ার আলো দেখতে পাওয়া আর না পাওয়ার বয়স সেটা নয়। বয়স যত বেড়েছে, ততই দৃষ্টিহীনতা নিয়ে জীবনে এগিয়ে যাওয়ার পথে পদে পদে মস্ত রকমের বাধার মুখোমুখি হয়েছেন।

দমে যাওয়াই ছিল তাঁর নিয়তি। কিন্তু এই নিয়তি ফয়সাল উল্টে দেওয়ার পণ করেছিলেন। এখন তিনি একজন পেশাদার অনুবাদক। রোহিঙ্গা ও বাংলা ভাষার লেখালেখি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। মাসে তাঁর আয় আড়াই লাখ টাকা।

ফয়সাল মোহাম্মদের বয়স এখন ২৬। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্বের ছাত্র। বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নে। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে চতুর্থ। ফয়সালের জন্ম হয়েছিল বাবার কর্মস্থল সৌদি আরবে, ১৯৯৬ সালে। জন্মের তিন মাস পর তিনি জলবসন্তে আক্রান্ত হন। সৌদির এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফয়সাল তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারান।

ফয়সালের বাবা মোহাম্মদ ইসমাইল প্রথম আলোকে জানান, সৌদি আরবে জলবসন্ত রোগটি পরিচিত নয় বলে তাঁরা ভুল চিকিৎসার শিকার হন।

ফয়সালের বয়স যখন পাঁচ, তখন তাঁরা সৌদি আরব থেকে রাঙ্গুনিয়ায় চলে আসেন। সেখানে ভর্তি হয়েছিলেন স্থানীয় এক মাদ্রাসায়। সেখানে পড়াশোনার উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় কিছুদিন পরই ভর্তি হন মুরাদপুরে সরকারি দৃষ্টি ও বাক্‌-শ্রবণপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে। শ্রুতলেখকের মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন মাধ্যমিক। নগরের সরকারি সিটি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়েন। গত বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছেন। এখন স্নাতকোত্তরের ছাত্র।

নতুন ভাষায় নতুন জীবন

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে রোহিঙ্গা ভাষার বেশ মিল। এ সুযোগে অল্প কয়েক দিনেই ভাষাটি শিখে নিয়েছিলেন ফয়সাল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে অনুবাদের কাজ করতেন। ইংরেজি ও রোহিঙ্গা ভাষার বিভিন্ন লেখা তিনি তাঁদের বাংলায় অনুবাদ করে দিতে।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে সহপাঠী রিয়াজুদ্দিন সাব্বিরের কাছে ফয়সাল ফ্রিল্যান্সিংয়ের কথা জানতে পারেন। রিয়াজুদ্দিন তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুবাদের বদলে ফ্রিল্যান্সিংয়ে গেলে তাঁর আয় কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। রিয়াজুদ্দিন তাঁকে এক ভারতীয় ফ্রিল্যান্সারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মে কীভাবে অনুবাদের কাজ করতে হয়, তিনিই তাঁকে শিখিয়ে দেন।

ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘দৃষ্টিশক্তি না থাকায় অনেকে বলতেন, আমাকে বাবার সম্পত্তির ওপর ভরসা করে বেঁচে থাকতে হবে। নিজে কখনো স্বাবলম্বী হতে পারবে না।’ এসব কথায় তিনি কান দেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে ওঠার পর তিনি চট্টগ্রামের এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিংয়ের কাজ শুরু করেন। ২০২০ সালের জুলাই থেকে সেই ভারতীয় নাগরিক তাঁকে অনুবাদের কাজ দিতে শুরু করেন। তখন তাঁর আয় ছিল মাসে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা।

আয় বাড়ল যেভাবে

ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে ফয়সাল বছরখানেকের মতো কাজ করেছেন। তাঁর কাছেই হাতেখড়ি ও প্রশিক্ষণ। ২০২১ সালের জুলাই মাসে মার্কিন কোম্পানি লায়নব্রিজে আবেদন করে ফয়সাল সেখানে অনুবাদকের কাজ পান। এখনো সেখানেই আছেন। তিনি এখন বাংলা ও রোহিঙ্গা ভাষা থেকে ইংরেজি এবং ইংরেজি থেকে রোহিঙ্গা ভাষায় লেখা অনুবাদ করেন। মাসে সাত-আটটি কাজ পান।

লায়নব্রিজ থেকে ফয়সালের মাসিক বেতন আসে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় সংস্থা ওয়াইজের মাধ্যমে। তাঁর গত তিন মাসের হিসাব প্রথম আলোর প্রতিবেদকের কাছে এসেছে। দেখা যায়, ফয়সাল গত এপ্রিলে ২ হাজার ২২৮, মে মাসে ১ হাজার ৯৯৪ এবং জুন মাসে ২ হাজার ৭৩২ মার্কিন ডলার পেয়েছেন। এই তিন মাসে তাঁর মোট আয় ৬ হাজার ৯৫৪ মার্কিন ডলার। টাকার হিসাবে প্রতি মাসে তাঁর গড় আয় ২ লাখ ৫১ হাজার টাকা।

যেভাবে কাজ করেন

দৃষ্টিহীন হলেও ফয়সাল স্ক্রিন রিডিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে মুঠোফোন ও কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারেন। কম্পিউটার ব্যবহারের জন্য তিনি বিশেষায়িত সফটওয়্যার এনভিডিএ ও জর্জের সাহায্য নেন। এই সফটওয়্যার দুটি কম্পিউটারের পর্দার লেখাগুলো পড়ে শোনায়।

ফয়সাল এখন পরিবারের সঙ্গে থাকেন চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসায়। ফয়সালের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, শোয়ার ঘরের এক কোণে রাখা টেবিলে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছেন। স্ক্রিনের দিকে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মনোযোগ নেই। ল্যাপটপের স্পিকার থেকে ভেসে আসা শব্দই মনোযোগ দিয়ে শুনছেন তিনি। তাঁর কাজ এগিয়ে চলেছে।

ফয়সাল জানান, অনুবাদগুলো তিনি পিডিএফ ফাইল করে লায়নব্রিজে তাঁর আইডিতে পাঠিয়ে দেন। সেটি কোন ভাষায় রূপান্তর করতে হবে, তার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ফাইল পাওয়ার পর তিনি সেটি কপি করে ল্যাপটপে গুগল ডক ফাইলে ওপেন করেন। এরপর লেখা পড়ে দেওয়ার সফটওয়্যার দিয়ে শোনেন। প্রতিটি লাইন ভালো করে শুনে শুনে ধাপে ধাপে অনুবাদ করেন।

সাহায্যের বদলে হেনস্তা

ফয়সাল লিখতে জানেন না। স্বাক্ষরের বদলে টিপসই ব্যবহার করেন। কিন্তু ব্যাংকের হিসাব খুলতে হলে স্বাক্ষর থাকা চাই। ফয়সাল বলেন, ফ্রিলান্সিংয়ের প্রথম উপার্জন পেয়ে তিনি অসম্ভব উচ্ছ্বসিত ছিলেন। কিন্তু সে আনন্দ মলিন হয়ে গিয়েছিল। আয়ের টাকা তুলতে গিয়ে হেনস্তার শেষ ছিল না। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকে হিসাব খোলার জন্য গিয়েছিলেন। ব্যাংক কর্মকর্তারা হিসাব না খুলে উল্টো টিপ্পনী কেটেছেন। শেষে তিনি অন্য ব্যাংকের একটি শাখার পরিচিত ব্যবস্থাপকের মাধ্যমে হিসাব খোলেন।

ফয়সালের জীবনে বাধা এসেছে, কিন্তু তিনি পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়ে ফয়সাল বলেন, অনুবাদকের এই চাকরিটা যত দিন সম্ভব তিনি করবেন। আশপাশের যাঁরা ফ্রিলান্সিং শিখতে আগ্রহী, তাঁদের তিনি প্রশিক্ষণ দিতেও আগ্রহী। বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের জনসম্পদে রূপান্তর করার একটা স্বপ্ন রয়েছে তাঁর মনে। দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়েও তিনি কাজ করতে চান।

মা-বাবার আনন্দাশ্রু

ছেলের সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে অশ্রু ধরে রাখতে পারেননি মা-বাবা দুজনই। প্রথম আলোকে তাঁরা বলেন, ছোট থেকেই ফয়সালের প্রতি ছিল তাঁদের বেশি স্নেহ। দুশ্চিন্তা ছিল তাঁদের অবর্তমানে ফয়সালের কী হবে। এখন আর সেই চিন্তা নেই। তাঁদের বিশ্বাস আছে, ফয়সাল নিজের সক্ষমতাতেই এগিয়ে যেতে পারেন।

সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আসমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবন্ধকতা ফয়সালের জীবনে কোনো বাধা তৈরি করতে পারেনি। দৃষ্টিহীন হয়েও তিনি যেভাবে উঠে দাঁড়িয়েছেন, পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছেন, শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে সেটা এক অবর্ণনীয় অনুভূতি। ফয়সাল অন্যদের জন্য বড় প্রেরণা হতে পারে।’