বিএনপির ২১২ নেতা কারাবন্দী

বিস্ফোরক আইনের মামলার আসামিরা নিম্ন আদালতে জামিন পাচ্ছেন না। তাঁদের উচ্চ আদালতে ছুটতে হচ্ছে।

কারাগারপ্রতীকী ছবি

রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অন্তত ২৫০টি মামলা হয়। ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের আগপর্যন্ত হওয়া এসব মামলায় সাড়ে চার হাজারের বেশি নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হন বলে দাবি দলের নেতাদের। বেশির ভাগের জামিন হলেও ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কারাবন্দী আছেন ২১২ নেতা-কর্মী। তাঁরা এখন উচ্চ আদালতে দৌড়ঝাঁপ করছেন।

বিএনপির নেতাদের অভিযোগ, মামলায় ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ সমর্থককেও গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গ্রেপ্তার এড়াতে অনেক নেতা-কর্মীকে বাড়ি ও কর্মক্ষেত্র ছেড়ে বাইরে থাকতে হয়েছে। এখন উচ্চ আদালতে গিয়ে জামিন পেতেও বেগ পেতে হচ্ছে।

এখনো কারাগারে চার শতাধিক নেতা-কর্মী

বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (রাজশাহী বিভাগ) রুহুল কুদ্দুস তালুকদার গত ২৮ অক্টোবরের পর রাজনৈতিক মামলার একটি পরিসংখ্যান দিয়েছেন। এ ছাড়া বিভাগের আট জেলার বিএনপি নেতা ও আইনজীবীদের কাছ থেকেও তথ্য পাওয়া গেছে। ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাঁদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে বগুড়ায়। এ জেলায় অন্তত ১০০টি মামলায় গ্রেপ্তার হন সাড়ে ৬০০ জনের মতো। যাঁদের মধ্যে ১০০ জনের বেশি এখনো কারাগারে। রাজশাহীতে ৪২ মামলায় গ্রেপ্তার হন ১ হাজার ৭০০ জন। এর মধ্যে ১০০ জনের বেশি নেতা-কর্মী এখনো জামিন পাননি। নাটোরে ২৩টি মামলায় গ্রেপ্তার হন পাঁচ শতাধিক। এখন জেলে আছেন পাঁচজন।

নওগাঁয় ১৯টি মামলায় ৭০৯ জন গ্রেপ্তার হন। এখন একজন কারাগারে আছেন। পাবনাতে ১১ মামলায় ৪৮৫ জন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এর মধ্যে তিনজন এখনো কারাগারে আছেন। সিরাজগঞ্জে ৩০টির মতো মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ৬৭১ জন। এখন কারাগারে আছেন তিনজন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৮টি মামলায় গ্রেপ্তার হন ৯০ জন। বর্তমানে কেউ কারাবন্দী নেই। জয়পুরহাটে ৯টি মামলায় ৩০০-এর মতো গ্রেপ্তার হন। এখন সবাই বাইরে।

‘দিনগুলো’ আর মনে করতে চান না তাঁরা

গত ডিসেম্বরে রাজশাহী নগরে ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে ১৭ বছরের এক কিশোরকে গ্রেপ্তার করে বোয়ালিয়া মডেল থানা-পুলিশ। তার বাড়ি পবা উপজেলায়। রাজশাহী শহরে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করতে এসেছিল। থাকত চাচার বাড়িতে। পরে অবশ্য ওই কিশোরকে আদালত জামিন দিয়েছেন। ওই কিশোরের বাবা বলেন, সেসব দিন ভুলবার নয়। ছেলের শিক্ষাজীবন নিয়ে শঙ্কায় পড়েছিলেন।

২৮ অক্টোবরের পর ফেরারি হয়ে ঘুরেছেন রাজশাহী জেলা যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক জুলফিকার রহমান। সম্প্রতি তিনি উচ্চ আদালতে জামিন পেয়েছেন। 

সাড়ে চার মাসের মধ্যে একবারও বাড়িতে ফিরতে পারেননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ সময়ে পুলিশ একাধিকবার তাঁর বাসায় গিয়েছে। তিনি বেশির ভাগ সময় বিভিন্ন মেসে থেকেছেন। কোথাও এক–দুই রাত, কোথাও একটু বেশি দিন। এতে করে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

অন্যের রিকশা ভাড়া নিয়ে চালান রাজশাহী নগরের ভদ্রার জামালপুর এলাকার হামিদুল ইসলাম। গত ২৭ নভেম্বর পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। পরে তিনি গত ২৭ জানুয়ারি জামিনে মুক্ত হন। হামিদুল বলেন, গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে তাঁর স্ত্রীকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এই দিনগুলো আর মনে করতে চান না। কোনো পদ নেই, শুধু দলটাকে ভালোবাসেন, এটাই তাঁর অপরাধ ছিল। জেলে কাটাতে হলো দুই মাস। 

উচ্চ আদালতে দৌড়ঝাঁপ

ঢাকার বনশ্রীর ভাড়াবাসা থেকে গত বছরের ২৫ নভেম্বর গ্রেপ্তার হন বগুড়া জেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম। এর পর থেকে তিনি বগুড়া কারাগারে রয়েছেন। তাঁর স্ত্রী ফাহিমা ইমু মুঠোফোনে (১৮ ফেব্রুয়ারি) প্রথম আলোকে বলেন, ২৮ অক্টোবরের পর তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে বগুড়ায় ১৫টির মতো মামলা হয়েছে। আগেও অনেক মামলা ছিল। এর মধ্যে তাঁর স্বামী কারাগারে অসুস্থ হয়ে বগুড়ার হাসপাতালে ভর্তি। আত্মীয়স্বজন জামিনের জন্য উচ্চ আদালতে দৌড়ঝাঁপ করছেন।

রাজশাহী নগরের বিনোদপুর এলাকার মনিরুল ইসলামকে গত ২৯ নভেম্বর বিএনপির মিছিল থেকে আটক করে পুলিশ। এখন পর্যন্ত তিনি জামিন পাননি। তাঁর মা সুমি খাতুন বলেন, ছেলে কোনো রাজনীতি করেন না। তবে বিএনপির মিছিলে যান। ছেলে কবে জামিন পাবেন, সেই আশায় দিন কাটছে। হাইকোর্টে জামিনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। এখনো (১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) সিরিয়াল পাননি।

রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ও আইনজীবী বীর মুক্তিযোদ্ধা এরশাদ আলী বলেন, এজাহারভুক্তদের রাজশাহীর আদালতে জামিন হচ্ছে না। এ কারণে উচ্চ আদালতে যেতে হচ্ছে। সেখানে বিএনপির আইনজীবীরা সার্বিক সহযোগিতা করছেন। তবে আইনজীবীরা টাকাপয়সা না নিলেও একটি জামিন পেতে ন্যূনতম খরচ ও হয়রানি তো আছেই।

রাজশাহীতে বিএনপির মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী আলী আশরাফ বলেন, সাধারণত বিস্ফোরক আইনের মামলার আসামিদের জামিন হচ্ছে না। রাজশাহীতে এসব মামলার আসামি প্রায় ৮০ জনের মতো। তাঁদের উচ্চ আদালতে যেতে হচ্ছে।

 নেতা-কর্মীদের আইনি লড়াইয়ের ব্যয়ের বিষয়টি প্রতিটি জেলার দায়িত্বশীল নেতারা দেখছেন বলে জানিয়েছেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার। তিনি বলেন, বিএনপির এখন প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে কারাগারে থাকা নেতাদের যত দ্রুত সম্ভব জামিনে বের করে নিয়ে আসা। কিছু জায়গায় জটিলতা হয়েছে। দ্রুত সময়ে তাঁরা সবাইকে সহযোগিতা করতে চান।