কিস্তির টাকায় কেনা ইজিবাইক হারিয়ে দিশাহারা কামাল

উপার্জনের একমাত্র সম্বল ইজিবাইক হারিয়ে বড় অনিশ্চয়তায় পড়েছেন কামাল শেখ–ময়না বেগম দম্পতি। ঈদের আমেজের এই সময়েও এক বেলা খাওয়ার মতো টাকা নেই তাদের। সোমবার বিকেলে জামালপুর পৌর শহরের পাথালিয়া গুয়াবাড়িয়া এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

টানা প্রায় ২৫ বছর প্যাডেলের রিকশা চালাতেন মো. কামাল শেখ (৫৫)। বয়স হওয়ায় এখন আর যাত্রী নিয়ে প্যাডেলের রিকশা চালাতে পারেন না। তাই কিস্তি ও সুদে টাকা নিয়ে বহু কষ্টে তিন মাস আগে ব্যাটারিচালিত একটি ইজিবাইক কিনেছিলেন তিনি। সেটি নিয়ে গেল চোরে। উপার্জনের একমাত্র সম্বল হারিয়ে কামাল এখন দিশাহারা। ঈদের আমেজের এই সময়েও এক বেলা খাওয়ার মতো টাকা নেই তাঁর কাছে। ফলে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা।

জামালপুর সদর উপজেলা পরিষদের সামনে থেকে গত ২৩ মার্চ বিকেল পাঁচটার দিকে চুরি হয় কামাল শেখের ইজিবাইকটি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে একটি চক্রের কয়েকজন তাঁর ইজিবাইকে ওঠেন। তারপর ওই উপজেলা পরিষদের সামনে এসে চক্রটি একজন পুলিশ সদস্যের বাসা থেকে কার্টন আনতে হবে বলে কামালকে নিয়ে রওনা হন। কিছুদূর গিয়ে সঙ্গে থাকা লোকটি উধাও হয়ে যান। এর মধ্যে অন্য সদস্যরা ইজিবাইক নিয়ে উধাও হয়ে যান। ইজিবাইকটি আর পাননি তিনি। সেই থেকে কেঁদেই যাচ্ছেন কামাল।

কামালের বাড়ি জামালপুর পৌর শহরের পাথালিয়া গুয়াবাড়িয়া এলাকায়। কামালের এক ছেলে ও দুই মেয়ে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছেলেটি মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। কামাল ও তাঁর স্ত্রী ময়না বেগম একটি টিনের ভাঙাচোরা ছাপরার নিচে বসবাস করেন। ইজিবাইকের আয় দিয়ে চালাতেন সংসার, পরিশোধ করতেন ঋণের কিস্তি।

গতকাল সোমবার সরেজমিন দেখা যায়, ছোট্ট একটি ভাঙাচোরা ছাপরা। ঘরের সামনে একটি চুলার সামনে কামালের স্ত্রী ময়না বেগম বসে আছেন। চুলায় আগুন নেই। কারণ রান্না করার মতো কিছুই ঘরে নেই। এক ঘণ্টা পর ইফতার, কী দিয়ে ইফতার করবেন তখনো ময়না বেগম তা জানেন না। পাশেই কামাল শেখ চৌকির ওপর বসে আছেন।

বহু কষ্টে দেড় শতাংশ জমি কিনে সেখানে ছাপরা তুলে দুজনে বসবাস করছেন। ঘরটি একদম ভাঙাচোরা। ঘরের পূর্ব পাশে শুধু একটি বাঁশের বেড়া। অন্য পাশগুলো ভাঙাচোরা বেড়া। এই ছোট্ট ঘরের মধ্যে এক পাশে একটি চৌকি ও অন্য পাশে গরু লালন-পালন করেন এই দম্পতি। ভিটা ছাড়া নিজেদের কোনো জায়গাজমিও নেই।

কামাল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ওই দিন শহরের বানিয়াবাজার এলাকায় দুজন যাত্রী গাড়িটি থামান। যাত্রীরা পুলিশ পরিচয় দেন। তাঁদের দ্রুত থানায় পৌঁছে দিতে বলেন। তাঁদের নিয়ে যাওয়ার সময় সিও অফিসের (সদর উপজেলা পরিষদ) সামনে একজন ইজিবাইক থামাতে বলেন। তখন তিনি (যাত্রী) বলেন, “চলো একজন পুলিশ সদস্যের বাড়ি থেকে একটি কার্টন ধরে আনতে হবে।” আমি সরল বিশ্বাসে ইজিবাইক রেখে তাঁর সঙ্গে ভেতরের গলিতে যাই। কিছুদূর যাওয়ার পর আমার সঙ্গে থাকা লোকটি দৌড়ে পালিয়ে যান। তখন আমার মনে হয়েছে, আমি চক্রের ফাঁদে পড়েছি। দৌড়ে এসে দেখি আমার ইজিবাইকটি নাই। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাইনি। এরপর সদর থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছি। পুলিশের চেষ্টায়ও সেটি পাওয়া যায়নি।’

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন কামাল। তিনি জানান, হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়ায় ছোটবেলায় পড়ালেখা করতে পারেননি। তাঁরা তিন ভাই ও পাঁচ বোন। তাঁদের মধ্যে কামাল সবার বড়। বাবাও একজন রিকশাচালক ছিলেন। সংসারে সহযোগিতার জন্য খুব ছোট থেকে কৃষিকাজ শুরু করেন। ১৫ বছর বয়সে বাবার রিকশা চালাতে শুরু করেন। মাঝেমধ্যে আবার কৃষিকাজও করতেন। তবে প্রায় ২৫ বছর ধরে প্যাডেলের রিকশা চালিয়েছেন তিনি। বয়সের ভারে শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। তাই প্যাডেলের রিকশা আর চালাতে পারছিলেন না। পরে তিনটি এনজিও থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা কিস্তিতে ঋণ নেন। ওই টাকায় নতুন একটি ইজিবাইক কেনেন।

ইজিবাইক হারানোর পর থেকে এনজিওর কিস্তি দিতে পারছেন না কামাল। এতে এনজিওর লোকজনও তাঁকে চাপ দিচ্ছেন। যেখানে খাওয়ার মতো কোনো টাকা নেই তাঁর কাছে, তিনি ঋণের কিস্তি দেবেন কীভাবে। ইজিবাইক হারিয়ে ঋণের চাপে তিনি এখন দিশাহারা। ইজিবাইক হারিয়ে যেন শূন্য হয়ে গেলেন। বারবার বলছিলেন, এখন কী করবেন, কোথায় যাবেন, কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না। অসুস্থ মা আর পরিবারের অন্যদের নিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকবেন। কীভাবে সংসার চলবে।

কামালের স্ত্রী ময়না বেগম বলেন, ‘সারাটা জীবন শুধু কষ্টই করলাম। মানুষটি (কামাল) ছোট্ট থেকেই শুধু কষ্টই করল। তার শরীর এখন আর চলে না। তাই বহু কষ্টে তিনটি এনজিওর কাছ থেকে কিস্তিতে টাকা নিয়ে ইজিবাইকটি কিনেছিলাম। কিন্তু কিনার কয়েক দিনের মধ্যে ইজিবাইকটির মোটর জ্বলে গেল। তারপরও সুদের ওপর টাকা নিয়ে মেরামত করেছি। দিনরাত ইজিবাইক চালিয়ে কিস্তির টাকা জোগাড় করত মানুষটি। কিস্তির টাকা রেখে যা থাকত, তা-ই দিয়ে ডালভাত খেতাম। আর আমগরে মতো অসহায় মানুষের গাড়িটাই চুরে নিয়ে গেল। গত ১০ থেকে ১৫ দিন ঠিকমতো চুলা জ্বলে না।’

জামালপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ মহব্বত কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে জায়গা থেকে ইজিবাইক চুরি হয়েছে, সেখানকার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখা হয়েছে। ইজিবাইকটি উদ্ধারে পুলিশ কাজ করছে। ইজিবাইকটি উদ্ধারে পুলিশ সব ধরনের চেষ্টা করবে।’