গোলন্দাজের ‘ত্রাসের রাজত্ব’ গফরগাঁওয়ে

২০১৮ সালে ফাহমি গোলন্দাজ দ্বিতীয় দফায় সংসদ সদস্য হওয়ার পর তাঁর অনুসারীরা আরও বেপরোয়া হয়েছেন বলে স্থানীয় লোকজন জানান।

ফাহমি গোলন্দাজ

২০০৪ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহের গফরগাঁও পৌর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন শেখ ফরহাদ। পরে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াস উদ্দিনের পক্ষে স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ২০১৪ সালে ফাহমি গোলন্দাজ আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হওয়ার পর তাঁর অনুসারীদের হামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন ফরহাদ।

মা–বাবা, ভাই–বোন, স্ত্রীসহ শেখ ফরহাদ এখন থাকেন রাজধানীর আশকোনায়। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘আমার বাবা-মা বলেন, “বাবা, আমরা মারা গেলেও তুই বাড়ি যাস না। ওখানে ওরা তোকে মেরে ফেলবে!”’ ২০১৬ সালের ৩১ মার্চ চাচার মৃত্যুর খবরে এলাকায় গিয়েছিলেন শেখ ফরহাদ। সেদিনও তাঁর ওপর হামলা হয়। এরপর আর এলাকায় যাননি।

সন্ত্রস্ত জনপদে পরিণত হওয়া গফরগাঁওয়ের খণ্ডচিত্র এটি। তিন দশক থেকেই এলাকাটি সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিত। স্থানীয় ব্যক্তিদের ভাষ্যমতে, ২০১৮ সালে ফাহমি গোলন্দাজ দ্বিতীয় দফায় গফরগাঁওয়ের (ময়মনসিংহ-১০ আসন) সংসদ সদস্য হওয়ার পর তাঁর অনুসারীরা আরও বেপরোয়া হয়েছেন।

২০১৮ সালের নির্বাচনের পর ফাহমি গোলন্দাজের অনুসারীদের হাতে নির্যাতিত আওয়ামী লীগের ১৬ জন নেতা–কর্মীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের বেশির ভাগই আবার হামলা ও নির্যাতনের ভয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে যাননি। একই কারণে গণমাধ্যমে তাঁরা নাম প্রকাশ করতে চান না।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ফাহমি গোলন্দাজ ২০১৪ সালে প্রথম সংসদ সদস্য হওয়ার পর তাঁর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে আওয়ামী লীগেরই রাজনীতি করে—এমন কয়েক শ পরিবার গফরগাঁও ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। পরে তাঁদের কেউ কেউ রাজনীতি থেকে ‘নিষ্ক্রিয়’ হয়ে এলাকায় ফিরেছেন।

গফরগাঁও পৌর বাজারে পাঁচজন ব্যবসায়ী সাংবাদিক পরিচয় জানার পর এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। একজন বললেন, ‘কী লিখবেন আর কীই–বা হবে!’

নির্যাতিত স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের অভিযোগ, ফাহমি গোলন্দাজ কোনোভাবেই তাঁর বিরোধিতা সহ্য করতে পারেন না। এ কারণে সাবেক সংসদ সদস্য ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াস উদ্দিন ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ওবায়দুল আনোয়ারের অনুসারীরা বেশি হামলা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

তবে সংসদ সদস্য ফাহমি গোলন্দাজ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ওবায়দুল আনোয়ার, ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াসসহ কয়েকজন ঢাকায় তাঁর বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট করেছেন। তাঁরাই বিভিন্ন সময় এসব অভিযোগ তোলেন। আগামী নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় তাঁরা তৎপর হয়েছেন।

আওয়ামী লীগ করেও ‘রেহাই’ নেই

২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত গফরগাঁওয়ের সংসদ সদস্য ছিলেন ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াস উদ্দিন। ওই সময় গফরগাঁও পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন আবু তায়েব। তাঁর বড় ভাই মাহমুদুল হাসান গফরগাঁও পৌরসভার প্যানেল মেয়র ছিলেন। ছোট ভাই আহসান হাবীব ছিলেন গফরগাঁও সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক।

আবু তায়েব প্রথম আলোকে বলেন, গিয়াস উদ্দিনের পক্ষে কাজ করা তাঁদের জন্য কাল হয়েছে। তিনি পাঁচ বছর এলাকাছাড়া ছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর এলাকায় ফিরে হামলার শিকার হন। এতে তাঁর বাঁ হাতের তিনটি আঙুল অকেজো হয়ে গেছে।

জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ওবায়দুল আনোয়ার ২০১৫ সালের ১৭ অক্টোবর গফরগাঁওয়ের নিজ গ্রাম রসুলপুরে শেখ রাসেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান করতে গিয়ে হামলার শিকার হন। এরপর আর গ্রামে যাননি তিনি। সপরিবার এখন ঢাকায় থাকেন। ওবায়দুল আনোয়ারের অভিযোগ, ফাহমি গোলন্দাজ গফরগাঁওয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন।

একইভাবে সংসদ সদস্য ফাহমি গোলন্দাজের কারণে এলাকাছাড়া হয়েছেন গফরগাঁও পৌরসভার সাবেক মেয়র এবং কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক কায়সার আহমদ। কায়সার আহমদও সপরিবার ঢাকায় থাকেন। তবে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

চলতি বছরের ২০ মার্চ গফরগাঁওয়ের পাতলাশি গ্রামে ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াস উদ্দিনের বাড়ির সামনে ময়লা–আবর্জনা ফেলে রাখার অভিযোগ ওঠে ফাহমি গোলন্দাজের অনুসারীদের বিরুদ্ধে। গিয়াস উদ্দিনের স্ত্রী শাহানা আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বাড়িতে তিনটি তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি থানার ওসিকে ফোন করেও প্রতিকার পাননি।

গফরগাঁওয়ে সংসদ সদস্য ফাহমি গোলন্দাজের সন্ত্রাসীরা যাকে খুশি মারছে। হাত-পা ভেঙে দিচ্ছে। ঘরবাড়িতে হামলা করছে। পুরো গফরগাঁও এখন আতঙ্কিত এলাকা হয়ে গেছে।
ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াস উদ্দিন, আ.লীগের সাবেক সংসদ সদস্য

তবে গফরগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফারুক আহমেদের ভাষ্য, কে বা কারা তালা দিয়েছেন, তা তিনি জানেন না। আর ফাহমি গোলন্দাজের ভাষ্য, ক্যাপ্টেন গিয়াস জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। তাঁর দ্বারা নির্যাতিত লোকজনই ওই ঘটনা ঘটাতে পারেন।

গফরগাঁওয়ের দলীয় রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথমে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। পরে অবশ্য বলেন, পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো। তবে অনেক নেতা–কর্মীর মনে ক্ষোভ থাকতে পারে।

আক্রান্ত বিএনপির নেতা–কর্মীরাও

গত ২৪ জুলাই গফরগাঁও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মীর মোজাম্মেল হোসেনের বাড়িতে যুবলীগের নেতা–কর্মীরা হামলা করেন। একই দিন হামলার শিকার হন গফরগাঁও ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সামাদ মিয়া ও ছাত্রদল কর্মী আবু রায়হান।

মোজাম্মেল হোসেন প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, আগের দিন (২৩ জুলাই) গফরগাঁও ইউনিয়ন যুবলীগের কর্মী সমাবেশে সংসদ সদস্য ফাহমি গোলন্দাজ ঘোষণা দেন, যাঁরা বিএনপির নেতা–কর্মীদের প্রতিহত করতে পারবেন, তাঁদের যুবলীগের পদ দেওয়া হবে। এর পরদিনই তাঁর বাড়িসহ অন্য দুই ছাত্রদল কর্মীর ওপর হামলা চালানো হয়।

এর আগে ২৪ মে গফরগাঁও পৌর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি মাহবুবুল ইসলাম, ২১ মে পাঁচভাগ ইউনিয়ন যুবদল নেতা রাসেল আহমদ, ১৫ মে নিগুয়ারী ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সামছুল আলমকে মারধর করা হয়।

বিএনপির স্থানীয় নেতা–কর্মীদের দাবি, গত ছয় মাসে গফরগাঁওয়ে বিএনপির শতাধিক নেতা–কর্মীকে মারধর করা হয়েছে। জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোফাখখারুল ইসলাম প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, গফরগাঁওয়ে বিএনপির রাজনীতি একপ্রকার নিষিদ্ধ। দলের নেতা–কর্মী বাড়িতে থাকলেও প্রতিনিয়ত তাঁদের ওপর হামলা হচ্ছে। ফেনীর জয়নাল হাজারীর মতো গফরগাঁওয়ে ‘নতুন হাজারী’ তৈরি হয়েছে।

হামলার শিকার বিএনপির ১৭ জন নেতা–কর্মীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। তাঁরা কেউ নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে চাননি। তাঁদের আশঙ্কা, গণমাধ্যমে নাম প্রকাশিত হলে তাঁরা আবার আক্রান্ত হতে পারেন। এ কারণে তাঁরা হামলার শিকার হলেও পুলিশের কাছে যাননি।

বিএনপির নেতা–কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ প্রসঙ্গে সংসদ সদস্য ফাহমি গোলন্দাজ বলেন, অনেক সময় বিএনপির অন্তঃকোন্দলের কারণে এ রকম ঘটনা ঘটে। আর বিএনপির সময় যা হয়েছে, সে তুলনায় কিছুই হয়নি।

শিক্ষক ও ছোট দলের ওপরও হামলা

গত ৮ জুন গফরগাঁও সরকারি কলেজের দুজন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। শিক্ষকদের অভিযোগ, চাঁদার দাবিতে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সাহরিয়া হাসান, ছাব্বির হোসেন, নাজমুল হাসান ও মুরাদ হাসানের নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন কলেজে ভাঙচুর চালান। ওই সময় তাঁরা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইমরান হোসাইন ও সহযোগী অধ্যাপক মো. আবু রেজোয়ানকে লাঞ্ছিত করেন। পরদিন (৯ জুন) কলেজটিতে বিসিএস সাধারণ শিক্ষক সমিতির পাঁচ নেতাসহ ৪০ জন শিক্ষককে ১০ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে গফরগাঁও সরকারি কলেজের কয়েকজন শিক্ষক বলেন, এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা সংসদ সদস্য ফাহমি গোলন্দাজের অনুসারী।

ফাহমি গোলন্দাজের দাবি, কলেজের অধ্যক্ষ বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের নেতা। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে এ রকম ঘটনা ঘটিয়ে তিনি অনুষ্ঠান বানচালের ষড়যন্ত্র করেছিলেন।

তবে সংসদ সদস্যের এই বক্তব্য নাকচ করে দেন অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ।

গফরগাঁও সরকারি কলেজশিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষকদের লাঞ্ছনার ঘটনায় ১৫ জুন তাঁরা থানায় গিয়েছিলেন মামলা করতে, কিন্তু পুলিশ মামলা নেয়নি।

তবে গফরগাঁও থানার ওসি ফারুক আহমেদ দাবি করেন, ওই দিন শিক্ষক লাঞ্ছনার কোনো ঘটনা ঘটেনি।

গত ১ জুন গফরগাঁও রেলস্টেশন চত্বরে সিপিবি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে পথসভার আয়োজন করে। তখন পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক তাজমুন আহমেদের নেতৃত্বে ৮ থেকে ১০ জন সিপিবির নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালান। সিপিবির উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাইফুস সালেহীন প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, তাজমুন তাঁকে আক্রমণ করার সময় ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশ সদস্যরা ব্যবস্থা নেননি।

হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে যুবলীগ নেতা তাজমুন তাচ্ছিল্য করে বলেন, গফরগাঁওয়ে সিপিবির লোকজন আছে, এটাই তাঁর জানা নেই। আর সংসদ সদস্য ফাহমি গোলন্দাজ বলেন, এটি ভুল–বোঝাবুঝি থেকে হয়েছে।

গফরগাঁওয়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, এমনটা মনে করেন না ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ সুপার মোহা. আহমার উজ্জামান। তাঁর দাবি, কোনো ঘটনা ঘটলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি থানায় অভিযোগ করলে তাঁরা যথাযথ ব্যবস্থা নেন।

তথ্য সংগ্রহের জন্য ময়মনসিংহ থেকে সড়কপথে গফরগাঁওয়ে যান এই প্রতিবেদক। যাওয়ার আগে গফরগাঁওয়ের কয়েকজন সংবাদকর্মী সতর্ক করেন। গফরগাঁও পৌর বাজারে পাঁচজন ব্যবসায়ী সাংবাদিক পরিচয় জানার পর এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। একজন বললেন, ‘কী লিখবেন আর কীই–বা হবে!’

সরেজমিনে ঘুরে বোঝা গেল, পুরো গফরগাঁওয়ে ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করছে। তারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য গিয়াস উদ্দিনের বক্তব্যে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গফরগাঁওয়ে সংসদ সদস্য ফাহমি গোলন্দাজের সন্ত্রাসীরা যাকে খুশি মারছে। হাত–পা ভেঙে দিচ্ছে। ঘরবাড়িতে হামলা করছে। পুরো গফরগাঁও এখন আতঙ্কিত এলাকা হয়ে গেছে।