মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে যে সেতু

১৯৫২ সালের নির্মিত শুভপুর সেতু যুদ্ধের স্মৃতি বহন করে আজও টিকে আছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের শুভপুর এলাকায়প্রথম আলো

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সৈন্য, অস্ত্র ও রসদ পরিবহন দুর্বল করতে হলে ধ্বংস করতে হবে শুভপুর সেতু। আবার সড়কপথে ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াত নিরাপদ রাখতে হলে এই সেতু রক্ষা করতে হবে পাকিস্তানি সেনাদের। কৌশলগত কারণেই ফেনী নদীর ওপর স্থাপিত এ সেতু মুক্তিযুদ্ধকালীন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। শুভপুর সেতু রক্ষায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ৪ দফা বড় যুদ্ধে জড়ায় পাকিস্তানি বাহিনী। তবে একেবারে ধ্বংস করা যায়নি স্টিলের তৈরি মজবুত সেতুটি। গায়ে অসংখ্য গুলির চিহ্ন নিয়ে এখনো কালের স্মৃতি বহন করছে সেতুটি।

ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলাকে ভাগ করেছে ফেনী নদী। দুই জেলাকে জুড়তে ১৯৫২ সালে পুরোপুরি ইস্পাতের কাঠামোয় সেতুটি তৈরি হয়। শুরুতে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২৯ মিটার। পরে দুপাশে নদী প্রশস্ত হলে ১৯৬৮ সালে আরও ২৪৯ মিটার সম্প্রসারণ করা হয় সেতুটি। ফলে এর মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৩৭৪ মিটার। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা ও ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলাকে যুক্ত করেছে এ সেতু।

মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বিভিন্ন বইপত্র ও দলিলে উল্লেখ আছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এ সেতুতে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলেন স্থানীয় জনতা। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় আক্রমণের পর ঢাকা ও কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি সেনারা যাতে দ্রুত চট্টগ্রাম ঢুকতে না পারে সে জন্য স্থানীয় লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে সেতুটি পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ও মিরসরাইয়ের বর্তমান সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন। স্থানীয় করেরহাট বাজার থেকে আলকাতরা ও কেরোসিন তেল এনে সেতুতে আগুন ধরানো হয়। আগুনে ইস্পাতের তৈরি সেতুটি পুরোপুরি অচল না হলেও প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছেতে বেশ বিলম্ব হয় পাকিস্তানি বাহিনীকে।

শুভপুর সেতু এলাকার সম্মুখ যুদ্ধে নিহত ইপিআর সদস্যদের কবর। সম্প্রতি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের শুভপুর এলাকায়
প্রথম আলো

এরপর থেকে সেতু রক্ষায় পাকিস্তানি বাহিনী ভারী অস্ত্রসহ পাহারা বসায়। ২৯ মার্চ স্থানীয় করেরহাট স্কুলের মাঠে এক সভায় বামপন্থী নেতা ওবায়দুল হক খন্দকার সেতুটি দখলে নিতে আহ্বান জানালে ইপিআরের পশ্চিম অলিনগর বিওপি ক্যাম্পের সদস্য ও স্থানীয় যুবকেরা পাক বাহিনীর ওপর হামলা করেন। তবে সে হামলা সফল হয়নি তখন। পরে ৩১ মার্চ হাবিলদার মইনের নেতৃত্বে আরেক দফা মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে। এ যুদ্ধে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ৭ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হন।

২৩ এপ্রিল ফেনী শহরে ও ২৫ এপ্রিল করেরহাটে পরাজয়ের পর সেতুর দক্ষিণপাশ ছেড়ে উত্তর পাশে বাংকার করে অবস্থান নেন মুক্তিযোদ্ধারা। সেসময় পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ্য করে তীব্র আক্রমণ করে। একপর্যায়ে নদী পার হয়ে উত্তর পাড়ে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পড়ে ১০০ জন পাক সেনা প্রাণ হারায়। এ যুদ্ধে শহীদ হন বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও। ১২ মে সেতু দখলের জন্য দিনব্যাপী পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। এ ছাড়াও যুদ্ধের পুরো সময় জুড়ে এ সেতুকে কেন্দ্র করে অসংখ্য খণ্ড যুদ্ধ হয়।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সেতুটির দুপাশে বড় বড় বালুর স্তূপ। সেতুর নিচে নদীতে বাঁধে বেশ কিছু বালুবাহী নৌকা। আশপাশে বালু শ্রমিকদের হাঁকডাক। তেমন সংস্কার করা না হলেও প্রাচীন এ সেতুর ওপর দিয়ে চলছে ছোট-বড় নানা যানবাহন। অনেক স্থানেই ক্ষয়ে গেছে পাটাতন। ভেঙে পড়েছে একপাশের রেলিংয়ের একাংশ। পুরো সেতুটিতে চোখে পড়ে অবহেলার ছাপ।

সেতুর গার্ডারে এখনো রয়ে গেছে একাত্তরের সম্মুখ যুদ্ধের বুলেটের চিহ্ন। সম্প্রতি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের শুভপুর এলাকায়
প্রথম আলো

বর্তমানে মিরসরাইয়ের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘তখনকার সময় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে হলে শুভপুর সেতু হয়েই যেতে হতো। আমরা চিন্তা করেছিলাম শুরুতেই এ সেতু ধ্বংস করে দিতে পারলে পাকিস্তানি বাহিনী চট্টগ্রাম ঢুকতে পারবে না। কিন্তু সেতু উড়িয়ে দেওয়ার মতো বিস্ফোরক সংগ্রহ করতে পারিনি। ২৫ মার্চ রাতে আলকাতরা ও কেরোসিন ঢেলে সেতুটি পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ধাতব স্থাপনা হওয়ায় পুরোপুরি ধ্বংস করতে না পারলেও কিছুটা ক্ষতি করতে পেরেছিলাম। এতে পাক সেনাদের চট্টগ্রাম যাওয়া বিলম্বিত হয়। শুভপুর সেতুর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেতুটি রক্ষা করা প্রয়োজন।’