দিনাজপুরে চাহিদা অনুযায়ী নেই সার
আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে সারের চাহিদা দ্বিগুণ হবে। সংকটের কারণে কৃষককে বেশি দাম দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে।
ধানের জেলা হিসেবে সুখ্যাতি আছে উত্তরাঞ্চলের বড় জেলা দিনাজপুরের। শুধু ধান নয়, আম-লিচুসহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি চাষেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই জেলা। এখান থেকে প্রায় সব ধরনের শাকসবজি ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্তে যায়। সেই দিনাজপুর জেলায় ফসল উৎপাদনের জন্য চাহিদা অনুযায়ী সার পাচ্ছেন না কৃষক।
কৃষকেরা বলেন, বরাদ্দ কম থাকায় পরিবেশকের দোকান ও খুচরা বাজার থেকে বেশি দামে সার কিনছেন তাঁরা। সম্প্রতি জেলার কাহারোল উপজেলায় সারের জন্য কৃষকের বিক্ষোভ করার ঘটনাও আছে। সারের দাম বাড়ায় বাড়ছে উৎপাদন খরচও।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন দিনাজপুর শাখার হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেলায় ইউরিয়া সারের চাহিদা ৫৫ হাজার ৫৯১ মেট্রিক টন, এমওপি ৪১ হাজার ১৩৬ মেট্রিক টন এবং টিএসপি সারের চাহিদা ছিল ১৭ হাজার ৪৫২ মেট্রিক টন। এ চাহিদার বিপরীতে ২৮ হাজার ৭৮০ মেট্রিক টন ইউরিয়া, ৭ হাজার ৫৩ মেট্রিক টন এমওপি এবং ৫ হাজার ৬২০ মেট্রিক টন টিএসপি বরাদ্দ পাওয়া গেছে। তিন মাসে জেলায় চাহিদার বিপরীতে ইউরিয়া সার ৫২ শতাংশ, এমওপি ১৭ শতাংশ এবং টিএসপি ৩২ শতাংশ সরবরাহ করা হয়েছে।
যদিও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নুরুজ্জামান বলছেন, ‘জেলায় পর্যাপ্ত সার রয়েছে। এমওপি সারের কিছুটা ঘাটতি ছিল, সেটাও পূরণ করার প্রক্রিয়া চলছে। আমনের সময় সার পৌঁছাতে খানিকটা বিলম্ব হয়েছিল। নভেম্বরে শীতকালীন কৃষিপণ্য উৎপাদনে কৃষককে পর্যাপ্ত সার সরবরাহ করতে আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি।’
স্থানীয় কয়েকজন বলেন, এ জেলায় সম্প্রতি আমন আবাদের কাজ শেষ হয়েছে। জেলার দ্বিতীয় প্রধান ফসল আলুসহ শীতকালীন সবজি লাগানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন কৃষক। গত রোববার সদর উপজেলার ঘুঘুডাঙ্গা, উলিপুর, মাসিমপুর এলাকা ঘুরে কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আমন চাষে সারের চাহিদা কিছুটা কম হলেও আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে সারের চাহিদা দ্বিগুণ হবে।
উলিপুর ভেদারমোড় এলাকার কৃষক মাজহারুল ইসলাম জানান, সংকট থাকায় ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সার বিঘাপ্রতি অন্তত পাঁচ-সাত কেজি কম প্রয়োগ করেছেন তিনি। পরিবেশকের দোকানে দুই বস্তা সার কিনতে গেলে পেয়েছেন এক বস্তা। তিনি বলেন, ‘সারসংকট আছে কি না, জানি না। তবে ডিলাররা আমাদেরকে জানিয়েছেন, সামনে আলু লাগানোর মৌসুম শুরু হচ্ছে, আবারও সারের সংকট দেখা দিতে পারে ভেবে অনেকেই সার কিনে মজুত করছেন।’
সরকার ইউরিয়া সারের দাম প্রতি বস্তা ১ হাজার ১০০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু কৃষক ইউরিয়া কিনছেন প্রতি বস্তা ১ হাজার ৪০০ টাকায়। এভাবে কৃষককে এমওপি সারের সরকার নির্ধারিত দাম ৭৫০ টাকার পরিবর্তে ১ হাজার ২০০- থেকে ১ হাজার ৫০০, ডিএপি ৮০০ টাকার বদলে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ এবং টিএসপি ১ হাজার ১০০ টাকার বদলে ১ হাজার ৪০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে চিরিরবন্দর উপজেলার ফুলপুর গ্রামের কৃষক এনামুল হক বলেন, ‘তিন একর জমিতে লাগাইছি। উচিত মূল্য দিয়ে আমরা সার পাই নাই। মূল্য বেশি দিয়ে সার কিনছি। সার দোকানত নুকি (লুকিয়ে) থুইয়ে সংকট দেখাইছে। পয়সা বেশি দিলে আবার পাওয়া যায়।’
জেলায় বিসিআইসি ও বিএডিসির অনুমোদিত সারের পরিবেশক আছেন ৩০৪ জন। এর বাইরেও উপজেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির অনুমোদিত প্রায় ছয় শতাধিক খুচরা সার বিক্রেতা রয়েছেন, যাঁরা পরিবেশকের ঘর থেকে সার কিনে খুচরায় বিক্রি করেন। বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগে সম্প্রতি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে কয়েকজনকে জরিমানাও করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে সদর উপজেলার এক খুচরা সার ব্যবসায়ী পরিবেশকের কাছ থেকে সার কেনার রসিদ দেখিয়ে বলেন, ‘কয়েক দিন আগে ডিলারপয়েন্ট থেকে সার কিনে আনছি। রসিদে দাম লিখা আছে ১ হাজার ১০০ টাকা। কিন্তু রসিদের সঙ্গে আরেকটি কাগজ দিয়েছে, সেখানে দাম আছে ১ হাজার ৪০০ টাকা। অর্থাৎ, বস্তাপ্রতি ৩০০ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হয়েছে। এরপর আমাদের পরিবহন খরচসহ লাভ করতে হলে বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা বেশি দাম রাখতে হয়। তা ছাড়া ৫ কেজি, ১০ কেজি খুচরায় বিক্রি করতে হলে কিছু সার তো নষ্টও হয়।’
ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের দপ্তর সম্পাদক মনোহর আলম বলেন, কৃষকের চাওয়ার সঙ্গে বরাদ্দের অসামঞ্জস্য রয়েছে। কৃষকেরা সার পেতে ডিলারের কাছে হন্যে হয়ে ঘুরছেন। ডিলাররাও উপায়ান্তর না দেখে সার আমদানিকারকদের কাছ থেকে তাঁদের বরাদ্দবহির্ভূত সার বেশি দামে কিনে কৃষককে সরবরাহ করছেন। এসব সার আনতে বাড়তি করতে হয়।
তবে দিনাজপুরে সারের কোনো সংকট নেই বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থার (বিএডিসি) (সার) যুগ্ম পরিচালক আ ফ ম আফরুজ আলম। তবে রোববার দুপুর পর্যন্ত তাঁদের কাছে ৫ হাজার ৮২০ মেট্রিক টন টিএসপি, ডিএপি ৯ হাজার ১২৫ মেট্রিক টন মজুত ছিল। তবে এমওপি সারের কোনো মজুত নেই। এবার সময়মতো সার সরবরাহ না হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক আছে। সামনে রবি মৌসুমে সারের চাহিদা বাড়বে। এ কারণে অনেকে সার বেশি করেও কিনে রাখছেন।