কুমিল্লা নগরে ৩০ বছরে ৭০টি পুকুর ভরাট

কুমিল্লা নগরের দ্বিতীয় মুরাদপুরের নারায়ণ পুকুরটি ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। সোমবার বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

প্রাচীনকাল থেকেই কুমিল্লা পরিচিত ব্যাংক ও ট্যাংকের (পুকুর) শহর হিসেবে। শহরে ব্যাংকের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়লেও কমে গেছে পুকুরের সংখ্যা। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে এখানে একের পর এক ভরাট হচ্ছে পুকুর। ফলে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা আর শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে পরতে হচ্ছে নগরবাসীকে। ক্ষেত্র বিশেষে মামলা ও নোটিশ দিয়ে দায় এড়াচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পুকুর ও জলাশয় রক্ষায় কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেই।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতি মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুরের বাইরে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জেলখানা, পুলিশ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ পুকুর ভরাট করে স্থাপনা তৈরি করেছে। জেলখানা কর্তৃপক্ষ জলাশয় ভরাট করে ১৪ তলার বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে। আমরা প্রতিবাদ করেও কিছু করতে পারিনি।’

গত ৩০ বছরে কুমিল্লা নগরের অন্তত ৭০টি পুকুর ভরাট হয়ে গেছে বলে উল্লেখ করেছেন বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকেরা। ভরাট হয়ে গেছে জিনার পুকুর, কোরবান আলী সর্দার পুকুর, মুরগি ব্যাপারীর পুকুর, ডিগাম্বরীতলার অমূল্য পুকুর, হোচ্ছামিয়া স্কুলের পুকুর, জামতলার শিবার পুকুর, তেলিয়া পুকুর, ঈশ্বর পাঠশালার পুকুর, ধর্মসাগরের পশ্চিমপাড়ের খান ভিলার পুকুর, মাস্টারবাড়ির পুকুর, ছোটরা জেলখানা এলাকার পাক্কি পুকুর, কেডি রায়ের পুকুর, বিসিক শিল্পনগরীর আটটি পুকুরসহ আরও অসংখ্য ছোটবড় জলাশয়।

কুমিল্লা উত্তর জেলা জাতীয় পার্টির সাবেক সভাপতি লুত্ফর রেজা খোকন বলেন, কুমিল্লা নগরের ঝাউতলার প্রতিটি বাড়ির সঙ্গে একটা করে পুকুর ছিল। আজ পুরো ঝাউতলা এলাকাতে হাত ধোয়ার জন্য একটা পুকুর নেই। কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকের সামনের পুকুর, ধর্মসাগরপাড়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের পুকুর, পুলিশ লাইনসের ভেতরের চারটি পুকুর, কুমিল্লা নগরের রেসকোর্স জলাশয়—সব এখন অতীত।

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপপরিচালক মোসাব্বের হোসেন মুহাম্মদ রাজীব বলেন, ‘জলাশয় ও পুকুর ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত কার্যক্রম অব্যাহত আছে। কুমিল্লায় কোনো অবস্থাতেই পুকুর ভরাট হতে দেওয়া হবে না। যাঁরা আইন লঙ্ঘন করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে আমরা মামলা করেছি। অনেককে নোটিশও দেওয়া হয়েছে।’

কুমিল্লা শহরের ৮৫৩টি পুকুর ছিল বলে জানান কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ছাত্রসংসদের সাবেক ভিপি (সহসভাপতি) সফিকুল ইসলাম শিকদার। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘ভরাটের পর আজ পর্যন্ত কয়টি পুকুর উদ্ধার হয়েছে?’

গত ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসের দিন দুপুরে হঠাৎ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে ঢুকে পড়েন অন্তত ৫০ জন নারী-পুরুষ। মুরাদপুর এলাকার ২৫০ বছরের পুরাতন ঐতিহাসিক হাতিপুকুর পুনরায় খনন ও ভূমিদস্যুদের হাত থেকে অবমুক্ত করার দাবি জানান তারা। এ সময় জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তরের নেতা ও পরিবেশকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে, গত ২৩ জুন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয় মুরাদপুর নারায়ণ পুকুরের উত্তর পাশের ৩৪ শতাংশ জমি ভরাট করার অভিযোগে আবু ফয়সাল রায়হান নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর।

ইতিহাসবিদ আহসানুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘কুমিল্লা দিঘি ও পুকুরের শহর। পরিপাটি একটি শহর ছিল এটি। প্রায় সব বাড়ির সামনে পুকুর ছিল। শান্ত, টলটলে পানি দেখে মুগ্ধ হতাম আমরা। পুকুরের ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যেত। এখন পুকুরের সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। যেগুলো টিকে আছে, তা–ও ভরাটের তোড়জোড় চলছে।’ জেলা রেজিস্ট্রার দপ্তরের উত্তর পাশের পুকুর, লাকী হাউসের পুকুর, কাসেমুল উলুম মাদ্রাসার পাশের দুটি পুকুর, ঠাকুরপাড়া পাল বাড়ির পুকুর, কালিয়াজুরি এলাকার শান্তি পুকুর, নাদিপা হাউজিং পুকুর, চকবাজার বাসস্ট্যান্ডের পুকুর, চানকালীবাড়ি পুকুর, ডিগাম্বরীতলা বিহারী পুকুর, ঝাউতলা খানসাহেবের ২২ গণ্ডা পুকুরসহ অন্তত ৭০টি পুকুর নাই হয়ে গেছে শহর থেকে তিনি উল্লেখ করেন।

এ ছাড়া শহরের উত্তর চর্থার তেলিয়া পুকুর, সংরাইশ এলাকার কালীমন্দির পুকুরসহ তিনটি পুকুর, মানিক মিয়া কমিউনিটি সেন্টার পুকুর, মেট্রো বেকারির পাশের পুকুর, কুমিল্লা অজিত গুহ মহাবিদ্যালয়ের সুপারিবাগানে দুটি পুকুর, ডিগাম্বরীতলার ধুমকলির পুকুর, ঠাকুরপাড়া মদিনা মসজিদ পুকুর, জোড়পুকুর, বাদুরতলা চৌধুরী পুকুর, মোগলটুলির লালা পুকুর, গর্জনখোলা পূর্ব পাড়ার পুকুর, কাপড়িয়াপট্রি বনবিহারী বাড়ির পেছনের পুকুর, দক্ষিণ চর্থা থিরা পুকুর, নগরের ঠাকুরপাড়া হেকিম সাহেবের পুকুর, হজরতপাড়ার ধোপা পুকুর, বৈদ্য পুকুর, চকবাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকার পুকুর, দারোগাবাড়িতে বড় আন্দরের পুকুর, হোসেন আলী মোক্তারের পুকুরসহ অধিকাংশ জলাশয় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বলে দাবি এলাকার লোকজনের।