মধ্যরাতে পুলিশ ফাঁড়িতে যুবলীগ নেতাদের পেটালেন সংসদ সদস্যের সঙ্গে আসা অনুসারীরা

বগুড়া জেলা যুবলীগের উপপ্রচার সম্পাদক জিয়াদুশ শরীফের ওপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে শহর শাখা যুবলীগের মানববন্ধন। আজ সোমবার বিকেলে বগুড়া শহরের সাতমাথা এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

বগুড়ায় পুলিশ ফাঁড়িতে আওয়ামী লীগ-দলীয় সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান ওরফে রিপুর সঙ্গে আসা নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যুবলীগের দুই নেতাকে লাঠি ও পাইপ দিয়ে বেধড়ক পেটানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল রোববার দিবাগত রাত ১২টার দিকে সদর ফাঁড়ি চত্বরে ঘটা এ ঘটনাকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ বলছেন সংসদ সদস্য। পুলিশ সুপার বলছেন, পুলিশের উপস্থিতিতে হামলার অভিযোগ সঠিক নয়।

হামলায় আহত যুবলীগ নেতা জিয়াদুশ শরীফ (পরাগ) বর্তমানে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন। তিনি জেলা যুবলীগের উপপ্রচার সম্পাদক। তাঁর সঙ্গে জেলা যুবলীগের সদস্য শিহাব উল আলমও (আদনান) হামলার শিকার হয়েছেন। তবে তাঁর আঘাত গুরুতর নয়। বগুড়া-৬ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। এ ঘটনার প্রতিবাদে আজ সোমবার বিকেলে মানববন্ধন করেছে বগুড়া শহর যুবলীগ।

প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় লোকজন ও আহত যুবলীগ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোববার রাত ১১টার দিকে শহরের সাতমাথায় জিলা স্কুলের ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন শাজাহানপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম। এ সময় সাতমাথা থেকে বেপরোয়া গতিতে উল্টো পথ দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে পুলিশ প্লাজার দিকে যাচ্ছিলেন আবীর নামের এক তরুণ। তিনি জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার পীরব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসিফ মাহমুদের ছেলে এবং সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসানের ছেলে প্রতীত আহসানের বন্ধু। আবীরের মোটরসাইকেলটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছাত্রলীগ নেতা রাকিবুলের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। রাকিবুল একপর্যায়ে মোটরসাইকেলের চাবি কেড়ে নেন। তিনি বাগ্‌বিতণ্ডার একপর্যায়ে ‘মদ্যপ’ বলে মন্তব্য করেন এবং আবীরের ওপর চড়াও হন। এ সময় যুবলীগের দুই নেতা জিয়াদুশ ও শিহাব ছাত্রলীগ নেতার পক্ষ নিয়ে আবীরকে গালমন্দ করেন। এতে আবীর ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁর বন্ধুদের ফোন দেন।

রাকিবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রাত সাড়ে ১১টার দিকে সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসানের ছেলে প্রতীত আহসানের নেতৃত্বে ৩৫-৪০ জন সাতমাথায় উপস্থিত হয়ে তাঁর ওপর হামলার চেষ্টা করেন। সেখানে সদর ফাঁড়ি পুলিশও উপস্থিত ছিল। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ দুই পক্ষকে সদর ফাঁড়িতে নেন। পুলিশের হস্তক্ষেপে বিষয়টা মিটমাট হওয়ার পথে। কিন্তু রাত ১২টার দিকে সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান ছেলের পক্ষ নিয়ে ফাঁড়িতে আসেন। পুরো বিষয়টি খুলে বলতে সেখানে যুবলীগ নেতা জিয়াদুশ শরীফ এগিয়ে গেলে তাঁর ওপর অতর্কিত হামলা চালানো হয়। এ সময় শিহাবের ওপরও হামলা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন বলেন, ফাঁড়ি পুলিশের ইনচার্জ (পরিদর্শক) সুজন মিঞা তাঁর কক্ষে দুই পক্ষকে নিয়ে মীমাংসার জন্য বসলে সংসদ সদস্য প্রায় অর্ধশত অনুসারী নিয়ে ফাঁড়িতে আসেন। তখন যুবলীগ নেতারা পুলিশ পরিদর্শকের কক্ষ থেকে বেরিয়ে ফাঁড়ির চত্বরে আসার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের সামনেই সংসদ সদস্যের সঙ্গে আসা অনুসারীরা হামলা চালান। হামলার পর রাগেবুল আহসান পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চান, তাঁর ছেলে কী অপরাধ করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোন আইনে ব্যবস্থা নেবেন? উত্তরে পুলিশ কর্মকর্তা সুজন মিঞা বলেন, তাঁর ছেলে অপরাধ করেননি। তাঁকে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন। এরপর রাগেবুল আহসান ছেলেকে নিয়ে গাড়ি করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। পুলিশ যুবলীগের দুই নেতা ছাড়াও ছাত্রলীগ নেতাকে ফাঁড়িতে আটক রাখেন। পরে একজনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়।

এ বিষয়ে সদর ফাঁড়ির পরিদর্শক (ইনচার্জ) সুজন মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের সামনে হামলার অভিযোগ সঠিক নয়। ফাঁড়ি চত্বরে দুই পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয়েছে বলে শুনেছেন। কাউকে আটক করা হয়নি। প্রতিপক্ষের হামলার শঙ্কায় নিরাপত্তার স্বার্থেই ফাঁড়িতে বসিয়ে রেখে রাত দুইটার দিকে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টা যেভাবে বলা হচ্ছে, সে রকম নয়। আমার ছেলে অসুস্থ। কয়েক দিন আগে অস্ত্রোপচার হয়েছে। হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে গতকালই (রোববার) বগুড়ায় ফিরেছে। রাতে খবর আসে, আমার ছেলে ও তার বন্ধুদের মারধর করা হয়েছে। সদর ফাঁড়িতে তাদের আটকে রাখা হয়েছে। অসুস্থ ছেলে, অস্ত্রোপচারের ক্ষত শুকায়নি। অজানা শঙ্কায় ছেলেকে নিতে রাতে গাড়ি নিয়ে সদর ফাঁড়িতে যাই। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেখানে আগে থেকে উপস্থিত থাকা কিছু ছেলে হঠাৎ যুবলীগ নেতা জিয়াদুশ শরীফের ওপর চড়াও হয়। পরাগ গত নির্বাচনে নৌকার সক্রিয় কর্মী ছিল। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। যা ঘটেছে, আমার অজ্ঞাতসারে ঘটেছে।’

হামলার শিকার জিয়াদুশ শরীফ বলেন, ‘সংসদ নির্বাচনে রাগেবুল আহসানের পক্ষে কাজ করেছিলাম। তিনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। রোববার রাতে সাতমাথায় তাঁর ছেলের বন্ধুর সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতার অপ্রীতিকর ঘটনা খুলে বলতেই তাঁর সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তিনি গাড়ি থেকেই নেমেই রুক্ষ মেজাজে আমার ওপর চড়াও হন। কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তাঁর সঙ্গে আসা বখাটে ছেলেরা আমার এবং আরেক নেতার ওপর লাঠি ও স্টিলের রড দিয়ে হামলা করেন। মাথায় রডের আঘাতে মাটিতে পড়ে গেলেও তাঁরা পেটাতে থাকেন। পুলিশের সামনেই এ হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশ সংসদ সদস্যের ভয়ে হামলাকারীদের আটক না করে উল্টো যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দুই নেতাকে আটক করেন। এ ঘটনায় মামলা করব।’

জেলা যুবলীগের সভাপতি শুভাশীষ পোদ্দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাত ১২টা থেকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুই নেতাকে ফাঁড়িতে আটকে রাখা হয়েছিল। রাত তিনটার দিকে ফাঁড়িতে গিয়ে মুচলেকা দিয়ে তাদের ছাড়িয়ে এনেছি।’

বগুড়ার পুলিশ সুপার (এসপি) সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী প্রথম আলোকে বলেন, ফাঁড়ির ভেতরে হামলার ঘটনা কেউ অবগত করেননি। তবে রাতে সদর আসনের সংসদ সদস্য তাঁর ছেলেকে মারধরের অভিযোগ এনে কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ার কথা বলেছিলেন। এ জন্য তাদের আটকে রাখা হয়েছিল। পুলিশ বিষয়টি মামলায় গড়াতে না দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে মিটমাট করে দিয়েছে। পুলিশের উপস্থিতিতে হামলার অভিযোগ সঠিক নয়।

এদিকে যুবলীগ নেতার ওপর হামলার প্রতিবাদে আজ সোমবার বিকেল ৫টায় শহরের সাতমাথায় মানববন্ধন করে বগুড়া শহর যুবলীগ। শহর যুবলীগের সভাপতি মাহফুজুল আলমের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক উদয় কুমার বর্মনের সঞ্চালনায় এ সময় আরও বক্তব্য দেন জেলা যুবলীগের সহসভাপতি মাইসুল তোফায়েল, সাংগঠনিক সম্পাদক মোশারফ হোসেন, দপ্তর সম্পাদক জাকারিয়া আদিল প্রমুখ। বক্তারা যুবলীগ নেতার ওপর হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান।