নোনামাটির স্বপ্নের ফসল তরমুজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা

প্রখর রোদে তরমুজের পরিচর্যা করছেন এক কৃষক। সম্প্রতি খুলনার দাকোপ উপজেলার খেজুরিয়া বিলের একটি তরমুজখেতে
ছবি: প্রথম আলো

ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত খুলনার দাকোপ উপজেলার বেশির ভাগ জমিতে নোনাপানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ হতো। বছর বিশেক আগে থেকে এলাকায় সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে লবণপানিতে চিংড়ি চাষের ঘেরগুলো বন্ধ হওয়া শুরু করে। লবণের প্রভাব কাটিয়ে এলাকায় আবার ফিরতে থাকে সবুজ ফসলের চাষাবাদ। একসময়ের এক ফসলি আমন ধানের এলাকায় কৃষকের ভরসা হয়ে ওঠে সুস্বাদু তরমুজ। অল্প সময়ে বিনিয়োগের দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ লাভ করায় দিনে দিনে নতুন নতুন কৃষক তরমুজ চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এখানকার কৃষকের কাছে তরমুজ হয়ে ওঠে স্বপ্ন পূরণের ফসল। কিন্তু সেই ফসলের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন চাষিরা।

অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২০২২ সালে উপজেলায় সবচেয়ে বেশি জমিতে তরমুজ চাষ করেন কৃষকেরা। হঠাৎ তরমুজের ব্যাপক দরপতন ও তার ওপর ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’-এর প্রভাবে কৃষক বড় মার খেয়ে যান। কোটি কোটি টাকার তরমুজ খেতেই নষ্ট হয়ে যায়। গতবারের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে নতুন আশা নিয়ে এবারও দাকোপের চাষিরা তরমুজ চাষে নেমেছিলেন। তবে এবারও চাষিদের চোখেমুখে হতাশার ছাপ। সোনার এই ফসল নিয়ে এখন সারাক্ষণ শঙ্কায় থাকতে হয় তাঁদের।

উপজেলার খুটাখালী গ্রামের তরুণ কৃষক অনুপ সরদার বলছিলেন, তরমুজের টাকা দিয়েই এলাকার মানুষের ভাগ্য ফিরেছে। তাঁদের আশা, তরমুজ চাষের লাভ দিয়ে অনেক কিছু করবেন। কিন্তু হচ্ছে না। এটা এখন জুয়ার মতো হয়ে গেছে। সার্বক্ষণিক চিন্তায় থাকতে হয়। যেদিন থেকে বীজ পোঁতা হবে, সেদিন থেকে বিক্রি শেষ করে হাতে টাকা না পাওয়া পর্যন্ত উদ্বেগ থেকে যায়। কখনো তরমুজের বীজ ফুটছে না, আবার কখনো পোকা ও  ভাইরাসের উৎপাত। অসময়ে বৃষ্টিবাদলের ভয়, আবার কখনো পানির তীব্র সংকট। আর দরপতনের শঙ্কা তো আছেই।

অনুপ সরদার এবার দেড় বিঘা জমিতে তরমুজ আবাদ করেছেন। খরচ হয়েছে প্রায় ৪২ হাজার টাকা। এই পরিমাণ জমিতে গত বছর ১ হাজার ৬০০টি তরমুজ হয়েছিল। এবার সব মিলিয়ে সাড়ে তিন শর মতো ফল হয়েছে। বৈরী আবহাওয়া, নাকি বীজের সমস্যা, না ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি, তা ধরতে পারছেন না তিনি।

অনুপ বলেন, গাছে পুরুষ ফুল বেশি ছিল। আবার কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে মৌমাছি আর আসে না। এরপরও হাতের মাধ্যমে পরাগায়ন করে যা ফল এসেছিল, গত মাসের শেষ দিকে বৃষ্টির পরে তা ঝরে গেছে। চৈত্র মাসে এত বেশি কুয়াশা আগে ছিল না। পুরো এলাকায় একই অবস্থা। খুটাখালীর শতকরা ৯০ শতাংশ কৃষক এবার আসল টাকা ঘরে তুলতে পারবেন না।

খেতের তরমুজ কেটে ব্যাপারীকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন রামনগর গ্রামের কৃষক বাবলু রপ্তান। এক ফাঁকে তিনি বললেন, অসময়ে বৃষ্টির কারণে এবার ফল বড় করতে পারেননি। বৃষ্টির পর ২০ দিন গাছের খাদ্য দিতে পারেননি। এ বছর অল্প লাভ হয়েছে। তবে অনেক কৃষকের চালান বাঁচবে না। এ ফসল দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় আর কত দিন তরমুজ চাষ করা যাবে, তা বলা মুশকিল।

খেত থেকে তরমুজ সংগ্রহ করে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সম্প্রতি খুলনার দাকোপের খেজুরিয়া বিল এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

যে কারণে তরমুজ চাষে ঝোঁক

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দাকোপে মূলত আমননির্ভর কৃষিব্যবস্থা চালু ছিল। লবণাক্ততা ও পানিসংকটের কারণে এখানকার কৃষক বোরো চাষে খুব একটা আগ্রহী হন না। আমন ধানের বীজ বোনা থেকে শুরু করে ফসল ঘরে তুলতে পাঁচ মাস সময় লাগে। প্রতি বিঘা আমন উৎপাদনে ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হয়। এক বিঘা জমির ধান বিক্রি হয় সর্বোচ্চ ১৮ হাজার টাকায়। সে ক্ষেত্রে প্রতি বিঘায় আমন আবাদে লাভ হয় সর্বোচ্চ ৭ হাজার টাকা। অন্যদিকে তরমুজে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত সময় লাগে সর্বোচ্চ আড়াই মাস। প্রতি বিঘায় খরচ হয় ২২-২৫ হাজার টাকা। তরমুজ বিক্রি হয় ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায়।

উপজেলা কৃষি দপ্তর সূত্রে জানা যায়, খুলনা জেলার মোট উৎপাদিত তরমুজের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ চাষ হয় দাকোপে। ২০২০ সালে দাকোপ উপজেলায় ১ হাজার ৫৩৫ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছিল। পরের বছর দ্বিগুণের বেশি হয়ে ৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়। ওই বছর চাষি ভালো দাম পাওয়ায় ২০২২ সালে উপজেলায় তরমুজ আবাদের জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৬০৫ হেক্টরে। গত বছর হঠাৎ ব্যাপক দরপতন আর তার ওপর ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’র প্রভাবে ব্যাপক মার খান তরমুজচাষিরা। চলতি বছর আবাদের পরিমাণ বেশ কিছুটা কমে যায়। বিশেষ করে সুতারখালী, কামারখোলা এবং তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের অনেক চাষি এ বছর তরমুজ লাগাননি। এ বছর দাকোপে ৬ হাজার ২৩০ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে।

যেসব কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে তরমুজ চাষ

দাকোপের কৃষক ও কৃষিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ভালো বীজের সংকট, ভেজাল বীজ আবার সেই বীজের দামও বেশি, সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও বেশি দামে সার বিক্রি, কীটনাশক ও হরমোন–জাতীয় ওষুধের লাগামহীন মূল্য ও কীটনাশকে অতিরিক্ত নির্ভরতা, মাটির গুণাগুণ সম্পর্কে ধারণা না থাকা, সেচের পানির অপ্রতুলতা, পোকার আক্রমণ, কৃষি কর্মকর্তাদের কর্তব্যে অবহেলার পাশাপাশি পরিবহন ও বিপণনব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ থাকায় কৃষকেরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন। তবে এ বছর ক্ষতির সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভাইরাস আর অসময়ের শিলা ও অতিবৃষ্টি।

দাকোপের পশ্চিম বাজুয়া গ্রামের চাষি দেবাশিস মণ্ডল বলেন, নদীতে লবণপানি। আর সময়মতো খালে বাঁধ না দেওয়ায় সেই লবণপানি খালেও ঢুকে পড়ে। তরমুজের শেষ সময়ে সেচ সংকট তীব্র হয়ে ওঠে। পাশের উপজেলার চেয়ে কীটনাশক সারের  দাম অনেক বেশি নেওয়া হয় এখানে। এসব দেখার কেউ নেই। বাজারে ভালো বীজের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নদী-খালের ইজারা অবুমক্ত ও খনন করে চাষের জন্য সেচের ব্যবস্থা করতে না পারলে এই ফসলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

কৃষি দপ্তরের ভাষ্য

দাকোপ কৃষি অফিসের কর্মকর্তারা বলছেন, ভাইরাসের কারণে অন্তত ১৫ শতাংশ খেত ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভালো বীজের সংকটের কথাও স্বীকার করেছেন তাঁরা। গতবার দাম না পাওয়ায় অনেক কৃষক উৎসাহ হারিয়েছেন। আবাদ কিছুটা কমেছে। এবারের ক্ষতিতে আবারও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। এদিকে মাঠে ২৮ জন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা থাকার কথা, কিন্তু দাকোপে আছেন মাত্র ৭ জন।

দাকোপ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কে এম মাকসুদুন্নবী বলেন, ‘জনবলের জন্য নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। আমরা সাধ্যের মধ্যে কৃষককে বোঝানোর চেষ্টা করি, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করতে না করি। তবে প্রত্যেকের বেশি সার-বিষ ব্যবহারের একটা প্রবণতা আছে। তাঁরা বেশির ভাগ সময় আমাদের কথা শোনেন না। একটা সমস্যা হলে কোম্পানির লোকের কাছে যান বা পাশের কৃষকের কথা শোনেন। সবচেয়ে বড় ভাবনার বিষয়, তাঁরা একটা কীটনাশকের সঙ্গে অন্যটা মিশিয়ে ব্যবহার করেন।’

তরমুজচাষিদের বাঁচাতে কৃষি দপ্তর বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে জানিয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আরও বলেন, কৃষি বিপণন বিভাগকে নিয়ে মাঠ দিবস করা হয়েছে। অন্য বছর ছোট গাড়িগুলো (পিকআপ) সিন্ডিকেট করে বড় গাড়ি ঢুকতে দিত না। পাশাপাশি বড় গাড়িতে রাস্তা ভেঙে যাওয়ার অজুহাত থাকত। এতে পরিবহনসংকট তৈরি হতো। এবার সব রকম গাড়ি ঢুকতে পারছে। লাউডোবে নতুন একটা ফেরিঘাটও হয়েছে। পরিবহন সংকট অনেকটা কমেছে। আর গরম থাকার কারণে চাষি দামটা পাবেন। একবারে ক্ষতি হবে না।