এক ভাই বিএনপির, আরেক ভাই জামায়াতের প্রার্থী

ভোটের মাঠে প্রচার চালাচ্ছেন বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা। তিনটি আসনে বিএনপির প্রার্থী পরিবর্তনের চেষ্টা করছে দলের একাংশ।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের চারটি সংসদীয় আসনে বিভিন্ন দলের মনোনীত প্রার্থীরা তৎপরতা চালাচ্ছেন। গত বৃহস্পতিবার তফসিল ঘোষণার পর মানুষের মধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

বিএনপির প্রার্থীরা প্রচার–প্রচারণায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেও জেলার তিনটি আসনে দলে অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। এসব আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে মানববন্ধন, সড়ক অবরোধ ও মশালমিছিল করেছেন বিএনপির একাংশের নেতা-কর্মীরা।

অবশ্য জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোস্তাফিজার রহমানের দাবি, ১৭ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামে দলের প্রত্যেক নেতা-কর্মীর ত্যাগ রয়েছে। এ জন্য সবাই মনোনয়ন দৌড়ে অংশ নিচ্ছেন। চূড়ান্ত মনোনয়ন না দেওয়ায় সবাই প্রতিযোগিতা করছেন মাত্র, এটা গ্রুপিং নয়। দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত হলে সবাই একসঙ্গে বিএনপির প্রার্থীর জন্য কাজ করবেন।

চারটি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে প্রচার–প্রচারণা চালিয়ে আসছে জামায়াতে ইসলামী। দলীয় নেতা–কর্মীরা নানাভাবে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও চারটি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। তিনটি আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এ ছাড়া নাগরিক ঐক্য, গণ অধিকার পরিষদ, জাকের পার্টির তৎপরতা রয়েছে কয়েকটি আসনে। জেলায় ভোটের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রভাব থাকলেও এবার এখনো দলটির নির্বাচনী কার্যক্রম নেই।

কুড়িগ্রাম-১ (নাগেশ্বরী-ভূরুঙ্গামারী)

আসনটিতে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুর রহমান (রানা)। এ নিয়ে দলে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার দাবিতে দুই উপজেলায় বিক্ষোভ ও মশালমিছিল করেছেন বিএনপির আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী ইউনুস আলীর অনুসারীরা। তিনি বিএনপিপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) যুগ্ম মহাসচিব।

ইউনুস আলী প্রথম আলোকে বলেন, দলীয় প্রাথমিক মনোনয়ন যিনি পেয়েছেন, তিনি এখন পর্যন্ত দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কোনো সমন্বয় করেননি। এতে দলীয় কোন্দল সৃষ্টি হয়েছে, সুশাসনের ব্যাঘাত ঘটেছে। এ বিষয়ে সাইফুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

জামায়াত এখানে প্রার্থী করেছে আনোয়ারুল ইসলামকে। তিনি এলাকায় বিভিন্ন উন্নয়ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। এনসিপির দলীয় মনোনয়ন পেয়ে প্রচার চালাচ্ছেন দলের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার প্রধান সমন্বয়ক মো. মাহফুজুল ইসলাম। এ আসনে জাকের পার্টির প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল হাই মাস্টার নিজে মাইকিং করে প্রচার চালাচ্ছেন।

কুড়িগ্রাম-২ আসন (সদর, ফুলবাড়ী ও রাজারহাট)

বিএনপি থেকে আসনটিতে প্রার্থী হচ্ছেন জেলা বিএনপির সদস্যসচিব সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদ। দলের অভ্যন্তরে কোন্দল না থাকায় স্বস্তিতে আছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘কুড়িগ্রাম-২ আসন জাতীয় পার্টির দুর্গ মনে করা হলেও এখন মাঠপর্যায়ে দলটি ভোটারশূন্য হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতার পর মাত্র একবার এই আসনে বিএনপি প্রার্থী সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। এবার ভোটারদের উৎসাহ এবং বিএনপির প্রতি সমর্থন দেখে আমরা আশাবাদী যে এই আসন বিএনপির হবে।’

আসনটিতে জামায়াতের প্রার্থী ইয়াসিন আলী। তিনি বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের জেলা সভাপতি। তিনি বলেন, ‘দুই বছর থেকে আমি জেলার বিভিন্ন স্থানে উঠান বৈঠক ও জনসংযোগ করছি। মাঠপর্যায়ে জনগণের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি।’

এনসিপির মনোনয়ন পাওয়া দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সমন্বয়ক আতিক মুজাহিদও আলোচনায় আছেন। তিনি উন্নয়নের নানা ভাবনা তুলে ধরে তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন। আতিক মুজাহিদ বলেন, ‘২৪–পরবর্তী সময়ে মানুষ দল নয়, যোগ্য প্রার্থী দেখে এবং বৈষম্যের তলানিতে থাকা কুড়িগ্রামের জন্য বরাদ্দ আদায় করে আনার যাঁর যোগ্যতা আছে, সেই মানুষকেই ক্ষমতায় চায়। আমরা সবাইকে নিয়ে বৈষম্যমুক্ত কুড়িগ্রাম গড়তে চাই।’

ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী হিসেবে প্রচারে আছেন মো. নূর বখত। তিনি ইসলামী আন্দোলন কুড়িগ্রাম জেলা শাখার সহসভাপতি।

কুড়িগ্রাম-৩ (উলিপুর)

বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে আসনটিতে প্রচারে নেমেছেন দলের সাবেক জেলা সভাপতি তাসভীর উল ইসলাম। তিনি বিএনপির সাবেক ভূমিমন্ত্রী প্রয়াত এ কে এম মাঈদুল ইসলামের ছোট ভাই। বিএনপির রংপুর বিভাগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল খালেকের সমর্থকেরা প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন। তাঁদের দাবি, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সামনের সারির নেতা ছিলেন খালেক। দলের দুঃসময়ে মাঠেও ছিলেন তিনি।

অভ্যন্তরীণ এই বিরোধ তাসভীর উল ইসলামকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। যোগাযোগ করা হলে তিনি মুঠোফোনে দলীয় বিভক্তি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

আসনটিতে ইসলামী আন্দোলন থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন মোহাম্মদ আক্কাছ আলী সরকার। তিনি ২০১৮ সালের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘উলিপুর পিছিয়ে থাকা এলাকা। এখানে মানুষ এবার পরিবার নয়, প্রার্থীকে গুরুত্ব দেবে। আমি আশাবাদী।’

এ ছাড়া জামায়াতের প্রার্থী সাবেক ছাত্রনেতা মাহবুবুল আলম সালেহী। তিনি ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক। এনসিপির মনোনয়ন পেয়েছেন মো. আবু সাঈদ জনি। গণ অধিকার পরিষদের নুরে এরশাদ সিদ্দিকীও প্রচার চালাচ্ছেন।

কুড়িগ্রাম-৪ (রৌমারী-রাজীবপুর-চিলমারী)

প্রধান দুটি দল থেকে দুই ভাই প্রার্থী হওয়ায় কুড়িগ্রাম-৪ আসন নিয়ে জেলার ভোটের রাজনীতিতে নানা আলোচনা চলছে। এখানে বিএনপির প্রার্থী আজিজুর রহমান ও জামায়াতের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান আপন ভাই। বড় ভাই আজিজুর রহমান রৌমারী উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি। বর্তমানে তিনি জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। মোস্তাফিজুর রহমান রৌমারী উপজেলা জামায়াতের সাবেক আমির।

এই ‘পারিবারিক লড়াইয়ের’ ভেতরেও বিএনপির প্রার্থী আজিজুর রহমানের জন্য নতুন অস্বস্তি তৈরি করেছেন জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সম্পাদক মমতাজ হোসেন লিপি। দলীয় প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর সমর্থকেরা।

মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি প্রায় এক বছর থেকে জামায়াতের মনোনীত প্রার্থী। হঠাৎ করে বড় ভাইকে বিএনপি থেকে মনোনয়ন দিয়েছে। তবে এখনো চূড়ান্ত করেনি। গত এক মাসে ভোটারদের মধ্যে কিছুটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও সবাই এটাকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছে।’

বিএনপির প্রার্থী আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমার ছোট ভাই একসময় বিএনপি করত। ১৯৯১ সালেও সে বিএনপির কর্মী হিসেবে আমার নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়েছিল। পরে জামায়াতে যোগ দিয়ে এখন ওই দলের প্রার্থী হয়েছে। একই পরিবারে দুই ভাই প্রার্থী হলেও আমাদের আত্মীয়দের মধ্যে কেউ ওর সঙ্গে নেই।’