৫০ বছর ধরে কাঁচিতে ধার তুলছেন শিবনাথ

৫০ বছর ধরে কাঁচিতে ধার তুলছেন শিবনাথ অধিকারী
ছবি: প্রথম আলো

বনবন করে ঘুরছে চাকতি। ঘূর্ণমান কালো রঙের চাকতিটার কার্নিশে কাঁচি লাগাতেই আগুনের ফুলকি বেরোচ্ছে। খানিক পরে ধার ফিরে আসছে ভোঁতা কাঁচিতে। ধার ফেরানোর কাজ যিনি করছিলেন, নাম তাঁর শিবনাথ অধিকারী। খুলনা সদর থানার মূল ফটকের সামনের রাস্তার ঠিক বিপরীতে শিবনাথের শাণঘর। ছেলের নামে দোকানের নাম রেখেছেন ‘হৃদয় শাণঘর’।

গতকাল শুক্রবার সকালে শাণঘরে বসে কথা হয় শিবনাথের সঙ্গে। লুঙ্গির সঙ্গে পরা শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। শাণ দেওয়ার সময় ছিটকে আসা আগুনের স্ফুলিঙ্গ থেকে রক্ষা পেতে তিনি চোখে পরেছিলেন চশমা।

আলাপে আলাপে জানা গেল, শিবনাথের বয়স এখন ৬২ বছর। বংশপরম্পরায় এ পেশায় এসেছেন। তাঁর ঠাকুরদাদা রামচন্দ্র অধিকারী থেকে বাবা গৌরচন্দ্র অধিকারীর এই শাণ দেওয়ার ব্যবসা ছিল। চতুর্থ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে ছেলে হৃদয় অধিকারীও পেশা হিসেবে এ কাজে ভিড়েছেন। এখন বাবা-ছেলে একসঙ্গে দোকান সামলাচ্ছেন।

শিবনাথদের বাড়ি নড়াইলের কালিয়া উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নের মাধবপাশা গ্রামে। বছর তিনেক আগে স্ত্রী মারা গেছেন। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেকে নিয়ে এখন থাকেন নগরের সদর হাসপাতালপাড়ায়। মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসেন।

কাজের শুরুর বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে শিবনাথের কাছ থেকে জানা গেল, ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে শিবনাথের বাবা বাগেরহাট সদরে গিয়ে কাজ শুরু করেন; পাশাপাশি ছিল সুপারির ব্যবসা। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই বাবার কাজে সহায়তা করতেন শিবনাথ। অস্টম শ্রেণিতে উঠে পড়াশোনার পাট চুকে যায়। অবশ্য এর মধ্যেই ভালোভাবে রপ্ত করে ফেলেন শাণ দেওয়ার কাজ।

শিবনাথ বলেন, ‘১৯৭২ সাল থেকে আমি পুরোদমে এ কাজ করছি। ১৯৮০ সালে খুলনায় চলে আসি। বড় ভাই রাধারমণ অধিকারী বাগেরহাটেই থেকে যান একই পেশায়। ছোট ভাই কমলেশ একসময় আমার সঙ্গেই কাজ শুরু করে, এখনো আমার সঙ্গেই আছে। আর যখন খুলনায় এসেছি, তখন সারা খুলনায় আমরা তিনজন এ কাজ করতাম। এখন শহরে সাতটার মতো শাণ দেওয়ার ঘর হয়েছে।’ মূলত দরজির কাজের কাঁচি আর সেলুনে ব্যবহৃত কাঁচিতেই শাণ দেন তাঁরা। ক্ষুরের প্রচলন বন্ধ হওয়ার আগে ক্ষুরেও শাণ দিতেন।

হাল আমলে আসবাবের নকশার কাজে ব্যবহৃত ক্লিপ মেশিন, সার্কুলার ব্লেড, রাউটার বিট—এসব যন্ত্রে শাণ দেওয়ার কাজও করছেন শিবনাথ। এসবের পাশাপাশি শাণ দেওয়ার চাকতিও তৈরি করেন তিনি। বিভিন্ন অঞ্চলের শাণঘরের মালিকেরা তাঁর কাছ থেকে শাণের চাকতি বানিয়ে নেন। কালো বালু উত্তপ্ত করে তাঁর মধ্যে গালা গলিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় শাণ দেওয়ার চাকতি তৈরি হয়। দরজির কাজের কাঁচি প্রতিটি ৩০ থেকে ৪০ টাকা আর সেলুনের কাঁচি ধারানোর জন্য প্রতিটি ২০ টাকা রাখা হয়। আর শাণের চাকতি বানিয়ে নিতে গেলে তাঁকে কারিগরি মজুরি বাবদ দিতে হয় পাঁচ হাজার টাকা।

শিবনাথ বলেন, ‘শহরের সেলুন দোকানের বেশির ভাগ লোকজনই আমাকে চেনে। শহরের দরজি ও সেলুনওয়ালারা তো আছেই, এর পাশাপাশি রায়েন্দা, মঠবাড়িয়া, শরণখোলা, সাতক্ষীরা, চুকনগর, তালা, দেবহাটা, আশাশুনি, শ্যামনগর, দেবহাটা, বটিয়াঘাটা, দাকোপ, পাইকগাছা, নড়াইল—এ রকম দূরদূরান্তের লোকজনও আমার দোকানে আসে।’

রূপসা ডিগ্রি কলেজে বাংলা বিভাগে অনার্স পড়ছিলেন শিবনাথের ছেলে হৃদয় অধিকারী (২৫)। দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর পড়া ছেড়ে চলে যান মালয়েশিয়া। তবে সেখানে ভালো না লাগায় দেশে ফিরে বাবার সঙ্গেই কাজ করছেন। কাজের ফাঁকে কথা প্রসঙ্গে হৃদয় বললেন, পেশা হিসেবে খারাপ লাগছে না। সব ব্যবসারই ভবিষ্যৎ ভালো, যদি জমিয়ে নেওয়া যায়।

কথা বলার একপর্যায়ে কাঁচিতে শাণ দিতে আসেন কার্তিক শীল নামের এক সেলুনকর্মী। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এখান থেকে কাঁচিতে ধার দিয়ে নিয়ে যাই। আমাদের শাণঘরে আসাই লাগে। কাজের চাপ বেশি থাকলে সপ্তাহের মধ্যেই কাঁচি ধারানো লাগে। কাজ কম থাকলে একটু বেশি দিন চলে।’

দিনে কেমন কাজ হয়, তা জানতে চাইলে শিবনাথ বর্তমানের সঙ্গে অতীতের তুলনা টেনে বলেন, ‘এখন সেভাবে কাজ নেই। আর করোনার সময় ব্যবসা একেবারে বন্ধ ছিল। জমানো টাকা ভেঙে খাওয়া লেগেছে। আগে এত কাজ ছিল যে সকাল ৭টায় বসতাম, রাত ১২টা বা ১টায় উঠতাম। এখন শাণের ঘর গ্রামগঞ্জে হয়ে গেছে।’

দোকানের তাকে সাজিয়ে রাখা নানা পদের বোতল আর কৌটা দেখিয়ে শিবনাথ অধিকারী বলেন, দোকানে সেলুনের প্রসাধনীও রাখা আছে। তবে এর বিক্রিও কমে গেছে। কোম্পানির লোকজন এখন গ্রাম পর্যন্ত এসব পণ্য পৌঁছে দিচ্ছেন। এখন প্রতিদিন গড়ে এক শর মতো কাঁচি ধারানোর কাজ হয়। কিছু আসবাবের মেশিনের কাজও হয়। দুই ঈদে কাজ একটু বাড়ে। কোরবানির ঈদে বাড়তি হিসেবে কিছু ছুরি-বঁটির কাজও আসে।

ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা শঙ্কার আঁচ মিলল শিবনাথের কথায়। তিনি বললেন, ‘এখন আমরা চালিয়ে নিচ্ছি, তাই চলে যাচ্ছে। বাজারের যে ঊর্ধ্বগতি, সবকিছুর খরচ বেড়েছে। ঘরভাড়া, বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ মিটিয়ে আয় দিয়ে আর পোষাচ্ছে না। সামনের দিনগুলো যে কেমন যাবে, তা নিয়েও চিন্তা হয়।’