বেতনবৈষম্যের শিকার ১৮ হাজার নারী শ্রমিক

শুঁটকিমহালে কাজে ব্যস্ত নারী শ্রমিক। আজ সোমবার কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেকে
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের নাজিরারটেক এলাকা। আজ সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টা। তপ্ত রোদে একটি খামারে শুঁটকি মাছ উৎপাদন করছেন পাঁচজন নারী শ্রমিক। গরমে নারীদের চেহারা কালো হয়ে গেছে। চামড়ায় উঠেছে ফোসকা। আট ঘণ্টা কাজের মজুরি নির্ধারণ এবং ন্যূনতম মজুরির দাবিতে আজ মহান মে দিবসে শ্রমিকেরা যখন শহরে সমাবেশ করছেন, তখন নাজিরারটেকে শুঁটকি উৎপাদনে ব্যস্ত নারী শ্রমিকেরা।
নাজিরারটেক উপকূলের ১৯টি গ্রামে গড়ে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ শুঁটকিমহাল। যেখানে রয়েছে ছোট-বড় ৯৫০টি মহাল। এলাকাটি পড়েছে কক্সবাজার পৌরসভার ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডে।

১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকতার কামাল বলেন, ৯ শতাধিক মহালে শ্রমিক রয়েছেন ২৫ হাজারের বেশি। এর মধ্যে অন্তত ১৮ হাজার নারী। নাজিরারটেক, কুতুবদিয়া পাড়া, সমিতি পাড়া, নুনিয়াছটা, ফদনারডেইলসহ অন্তত ১৯টি গ্রামে ৭০ হাজারের বেশি মানুষের বসবাস। এর ৯০ শতাংশ মানুষ শ্রমজীবী—দেশের বিভিন্ন উপকূল থেকে জলোচ্ছ্বাস ও দুর্যোগের কবলে ঘরবাড়ি, ভিটেমাটি হারিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু পুরুষের সমান কাজ করেও নারী শ্রমিকেরা মজুরি পাচ্ছেন অর্ধেক।

পেট চালাতে কাজে সাজেদা, রমিজারা
দুপুর ১২টা, প্রচণ্ড দাবদাহ। গরমে শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। এমন পরিস্থিতিতে নাজিরারটেকের একটি মহালে মাছ শুঁটকি করছেন সাজেদা বেগম নামের এক তরুণী। পাশের কয়েকজন নারী শ্রমিকও ব্যস্ত শুঁটকি তৈরিতে।

কাজের ফাঁকে সাজেদা বললেন, গরম বেশি বলে বসে থাকার জো নেই। এমনিতে সারা দিন কাজ করে পুরুষের অর্ধেক বেতন পাওয়া যায়, তার মধ্যে গরমের অজুহাতে বসে থাকলে কাজ থেকেও বিদায় হওয়ার শঙ্কা থাকে। ঘরে অসুস্থ মা, ওষুধের জন্য টাকা লাগে। আছে দুই ছেলেমেয়ে। শুঁটকিমহালে কাজ না করলে চারজনের পেটে ভাত জুটবে না।

সকাল সাতটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ১০ ঘণ্টা কাজ করে সাজেদা মজুরি পান মাত্র ৩৫০ টাকা। অন্যদিকে পুরুষেরা পান ৭০০-৮০০ টাকা। বেতনবৈষম্যের ব্যবধান তুলে ধরে সাজেদা বলেন, এ নিয়ে প্রতিবাদ করে বহু নারী শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। এলাকায় কাজেরও অভাব। সাগরে মাছ ধরা না পড়লে আবার অর্ধেক নারীকে বেকার থাকতে হয়।

আরেকটি মহালে শুঁটকি উৎপাদন করছেন রমিজা বেগম। তাঁর বাড়ি কুতুবদিয়ার আলী আকবরডেইল গ্রামে। নুনিয়াছটার বস্তিতে ভাড়ায় থেকে তিনি মহালে কাজ করেন। দৈনিক মজুরি পান ৩৫০ টাকা। তা দিয়ে কোনোমতে চালান সংসার।
রমিজা বলেন, পেটের দায়ে প্রচণ্ড গরমেও তাঁদের মহালে কাজ করতে হয়। পুরুষের সমান কাজ করেও অর্ধেক মজুরিতে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। রাজনৈতিক দলের নেতা, শ্রমিকনেতা বা সমাজের প্রতিনিধিরা নারী-পুরুষের মধ্যে বেতনবৈষম্য নিয়ে কথা বলেন না। কিন্তু নারী শ্রমিকেরা প্রতিবাদ করতে পারেন না চাকরি হারানোর ভয়ে।

নাজিরারটেক এলাকার ‘শাহ আমানত এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি মহালে শুঁটকি উৎপাদন করছেন অন্তত ১২ জন শ্রমিক। এর মধ্যে নারী ৭ জন। পুরুষের বেতন ৭০০ টাকা, নারীদের বেতন ৩৫০ টাকা। বেতনবৈষম্যের বিষয়ে জানতে চাইলে মহালের একজন শ্রমিক জানান, এটা মালিকপক্ষ বলতে পারবে।

তবে আরেকটি মহালের মালিক কায়সার উদ্দিন বলেন, পুরুষের মতো ভারী কাজ নারীরা করতে পারেন না। তাই তাঁদের বেতন কম।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এমন পরিস্থিতিতে নারী শ্রমিকেরা নিষ্ঠুর আচরণের শিকার হচ্ছেন জানিয়ে পৌরসভার প্যানেল মেয়র ও সংরক্ষিত ১ নম্বর ওয়ার্ডের (১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ড) কাউন্সিলর শাহিন আকতার বলেন, শুঁটকিমহালগুলোতে এখন ১৮ হাজারের বেশি নারী শ্রমিক কাজ করেন। নারীদের মজুরি দেওয়া হয় পুরুষের বেতনের অর্ধেক। কিন্তু অধিকার নিয়ে কথা বলার নারী সংগঠনও নেই মহাল এলাকায়।
বিকেলে উত্তর নুনিয়াছটা এলাকায় কথা হয় কয়েকজন নারী শ্রমিকের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, শক্ত অবস্থান না থাকায় নারীরা বেতনবৈষম্যের বিষয়ে ভূমিকা রাখতে পারছেন না।

আন্তর্জাতিক আইন মেনে নারী শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের পাশাপাশি ন্যূনতম মজুরি ৭০০ টাকা নির্ধারণের দাবিতে নারীরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন জানিয়ে নারী শ্রমিক সাবেকুন্নাহার বলেন, অধিকাংশ মহালে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। কাজ করতে গিয়ে বহু নারী অসুস্থ হচ্ছেন। কাজে আসা–যাওয়ার সময় বহু নারী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এসব বন্ধ করতে হবে।

শুঁটকিমহালসমূহ নিয়ন্ত্রণ করে ‘নাজিরারটেক মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি’। তাদের সদস্যসংখ্যা ১ হাজার ১১৭। সমিতির সভাপতি আতিক উল্লাহ। পুরুষের দৈনিক মজুরি ৭০০-৮০০ টাকা হলেও নারীদের দেওয়া হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আতিক উল্লাহ বলেন, যুগ যুগ ধরে এ নিয়ম চালু হয়ে আসছে। এ ছাড়া পুরুষের মতো নারীরা ভারী কাজ করতে পারেন না।

জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, গত বছর নাজিরারটেকের মহালসমূহ থেকে শুঁটকি উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ২১ হাজার মেট্রিক টন। চলতি মৌসুমে শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ হাজার মেট্রিক টন। যার বাজারমূল্য ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা।