‘যে ঘাম ঝরে, তার দাম পাই না’

শ্রমিকেরা মাথায় ইট নিয়ে যাচ্ছেন। আজ মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে রাজশাহী নগরের ভদ্রা এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

জিয়াউল হকের (৫০) মাথা গামছা দিয়ে মোড়ানো। গামছার ওপর খড়ের তৈরি বিড়া। মাথার ওপর একাই ইট সাজিয়ে নিয়ে ফেলছিলেন একটু দূরে। সকাল আটটা থেকে কাজ শুরু করেছেন। তপ্ত রোদে তাঁকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করতে হবে। মজুরি পাবেন ৬০০ টাকা।

জিয়াউল হক বলেন, ‘প্রচণ্ড গরম। প্রচুর ঘাম ঝরে। ঘাম শুকিয়ে শরীরেই বসে যায়। রাতেও কম ঘুম হয়। মাথা ঝিম ঝিম করে। সারা দিন কাজ করে পাই ৬০০ টাকা। এই টাকায় খুব ভালোভাবে চলা যায় না। কাজে ঘাম ঝরে, তার দাম পাই না।’

একটু দূরেই যন্ত্রের সাহায্যে ইট ভেঙে খোয়া বানানো হচ্ছিল। সেখানে বেশ কয়েকজন শ্রমিক কাজ করছিলেন। আলতাফ হোসেনের (৫৩) মাথায় বড় ঢালাভর্তি ইটের খোয়া। কিছুটা দূরে নিয়ে গেলেন সেই ভারী বোঝা।

আলতাফ হোসেন বলেন, ২০ থেকে ২২ বছর ধরে এই কাজ করছেন। শরীরে সয়ে গেছে। একসময় দিনে মজুরি পেতেন ১০০ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৬০০ টাকা। তবে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে আরও বেশি। ৬০০ টাকাতেও এখন বাজারসদাই করা যায় না।

সপ্তাহে কাজ পাই মোটে তিন-চার দিন। আর বাকি দিনই ফিরি যাইতে হয়। কাজ পাইলে গরম-টরম মানি। কিন্তু কাজই তো পাই না। এভাবে কাজ না পাইলে তো না খাইয়ে মরে যাব।
শহীদুল ইসলাম, শ্রমিক

আজ মঙ্গলবার সকালে এই দুজনের সঙ্গে কথা হয় রাজশাহী শহরের ভদ্রা এলাকায়। তাঁদের বাড়ি রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বেলপুকুর এলাকায়। সকালে তাঁরা শহরে কাজে এসেছেন। তবে শহরে এসে প্রতিদিন কাজ পাওয়া যায় না। আজ এই দুজন কাজ পেলেও অনেকে হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন।

শহরের তালাইমারী মোড়ে কাজের সন্ধানে শ্রমজীবী মানুষ জড়ো হন। সেখান থেকে প্রয়োজনমতো অনেকে শ্রমিক নিয়ে যান। আজ সকাল ৯টার দিকে সেখানে কথা হয় চারঘাট থেকে আসা শ্রমিক শহীদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সেই সকালে পান্তা ভাত খাইয়ে আইসেছি। সাইকেল চালায়ে আইসতে আইসতে মনে হয় শেষ হয়ে গিয়াছে পান্তা। এখনো কাজ পাচ্ছি না। সপ্তাহে কাজ পাই মোটে তিন-চার দিন। আর বাকি দিনই ফিরি যাইতে হয়। কাজ পাইলে গরম-টরম মানি। কিন্তু কাজই তো পাই না। এভাবে কাজ না পাইলে তো না খাইয়ে মরে যাব।’

কাজের অপেক্ষায় বসে আছেন কয়েকজন দিনমজুর। আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে রাজশাহী নগরের শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান চত্বরে
ছবি: প্রথম আলো

তালাইমারী মোড়ের মতো নগরের বিনোদপুর, শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান চত্বর, বর্ণারী মোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকেরা শ্রম বিক্রি করতে আসেন। রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলার গ্রাম থেকে কাকডাকা ভোরে শ্রমজীবী লোকজন আসেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর তাঁদের কেউ কাজ পান, কেউবা কাজ না পেয়ে চলে যান। তীব্র তাপপ্রবাহে কাজ না পাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে।

নগরের শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান চত্বরে কথা হয় পবা উপজেলার পারিলার মোতাহের হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, তিনি প্রতিদিনই কাজে আসেন। সব ধরনের কাজই পারেন। কিন্তু সপ্তাহে কাজ পান মোটে তিন থেকে চার দিন। এভাবে সংসার চালানো কঠিন। বাজারে জিনিসপত্রের দামও বাড়ছে। এই রোদে কাজ করতে গেলেও মালিকেরা বিশ্রামের সুযোগ দেন না। গরমের কারণে কাজ কমেছে।

একই এলাকায় কথা হয় মোন্তাজ আলীর সঙ্গে। তাঁর বাড়ি পবা উপজেলার মাহেন্দ্রা এলাকায়। প্রচণ্ড গরমে কয়েক দিন আগে তিনি অসুস্থ হয়েছিলেন, আবার কাজে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘একজন কাজে নিতে চেয়েছিলেন। পরে শুনলাম জায়গাটায় কোনো ছায়া নেই। এ কারণে গেলাম না। শরীরটা তো এখনো ঠিক হয়নি। আর রোদও তো খুব উঠেছে। ছায়া জায়গায় কাজ পেলে যাব।’

রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্রে জানা যায়, গত ৩১ মার্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর পর থেকে আর তাপমাত্রা কমেনি। বরং কয়েক দিন ধরে তা বেড়েই চলেছে। গত বৃহস্পতিবার ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, গত শুক্রবার সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, শনিবার ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, রোববার ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল সোমবার ছিল ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।