ছিন্নভিন্ন কুতুবদিয়ার সুরক্ষাপ্রাচীর, ৩০ বছরে উজাড় ৯০০ একর প্যারাবন
কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়ায় কয়েক দশক আগেও অন্তত ১ হাজার ২০০ একর প্যারাবন (ম্যানগ্রোভ) ছিল। ১০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপের সুরক্ষাপ্রাচীর হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল প্যারাবনকে। কিন্তু গত তিন দশকে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছে দ্বীপের সুরক্ষাপ্রাচীর। এই সময়ে ৯০০ একর প্যারাবন ধ্বংস হয়েছে লবণ মাঠ তৈরির জন্য। টিকে থাকা বাকি ৩০০ একর প্যারাবনও হুমকিতে পড়েছে আগ্রাসী লবণ চাষের কারণে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, দ্বীপের লেমশীখালী জেটিঘাট ও দরবার ঘাটে একাধিক খননযন্ত্র দিয়ে লবণ মাঠ তৈরি করা হচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা বলেন, আগে উপকূলের সরকারি খাসজমি দখল করে আওয়ামী লীগ নেতারা লবণ মাঠ করেছেন। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে সেই মাঠ দখলে নেন বিএনপি নেতারা।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি চট্টগ্রাম থেকে ভাসমান পন্টুনে করে সাগর পাড়ি দিয়ে কুতুবদিয়ায় ৩০টির মতো খননযন্ত্র এনেছেন। পেকুয়ার মগনামা ঘাট দিয়েও ট্রলারে আনা হয় আরও ১০-১২টি খননযন্ত্র। প্যারাবন উজাড় করে লবণ মাঠ তৈরিতে ব্যহৃত হচ্ছে এসব খননযন্ত্র।
কুতুবদিয়া বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি ও উত্তর ধুরুং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান আ স ম শাহরিয়ার চৌধুরী বলেন, খননযন্ত্র আনার পর থেকে দ্বীপের প্যারাবন নিধন করে লবণ মাঠ তৈরির হিড়িক পড়েছে। তাতে পরিবেশ–প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
কুতুবদিয়া দ্বীপের চারপাশে প্যারাবন থাকার পরও ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে উপজেলায় অন্তত ২৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। প্যারাবন উজাড় হওয়ায় বড় ঝড় হলে দ্বীপে ১৯৯১ সালের চেয়েও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করেন কুতুবদিয়া বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি শাহরিয়ার চৌধুরী। তিনি বলেন, এখন প্রবল গতিবেগসম্পন্ন আরেকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে দ্বীপে জানমালসহ সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হবে। বর্তমানে এই উপজেলার লোকসংখ্যা ১ লাখ ৫৩ হাজার।
বাড়ছে লবণ চাষের জমি, কমছে প্যারাবন
লেমশীখালী ইউনিয়নের দরবারঘাটের পশ্চিম পাশে প্যারাবনের বিশাল ভূমিতে চলছে লবণ চাষ। বেড়িবাঁধের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে একচিলতে প্যারাবন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কয়েক বছর আগেও এখানে ৫০-৬০ একরের প্যারাবন ছিল। আওয়ামী লীগের কিছু প্রভাবশালী নেতা ৫৫ একরের বেশি প্যারাবন উজাড় করে তাতে লবণ চাষ শুরু করেন। এখন সেই জমি বিএনপি নেতারা দখল করে নিয়েছেন। উপজেলায় লবণ মাঠ দিন দিন বাড়লেও প্যারাবন দ্রুত কমে যাচ্ছে।
দরবারঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, কয়েকজন শ্রমিক বাঁধের ভেতরে লবণ মাঠে কাজ করছেন। একজন শ্রমিক জানান, সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের লবণ মাঠ দখলে নিয়েছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও লেমশীখালী ইউপির প্যানেল চেয়ারম্যান নাজেম উদ্দিন। এখন সেই মাঠে লবণ চাষ করছেন নাজেম উদ্দিনের চাচাতো ভাই কৃষক লীগ নেতা আবদুল মান্নান। আওয়ামী লীগের আমলে এই মাঠ থেকে লবণ তুলতেন স্থানীয় রমিজ উদ্দিন। রমিজ উদ্দিন বলেন, তাঁর পরিবার লবণের মাঠের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ৫ আগস্টের পর বিএনপি নেতা নাজেম উদ্দিন তাঁর কয়েক একর লবণ মাঠ দখলে নিয়েছেন। কোথাও তিনি এর বিচার পাচ্ছেন না।
ঘটনাস্থলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুতুবদিয়া উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম বলেন, দরবার ঘাটে যে পরিমাণ প্যারাবন আছে, তদারকির অভাবে তা–ও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
প্যারাবন উজাড় ও সরকারি জমি দখল করে লবণ চাষের অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে বিএনপি নেতা নাজেম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ইউনিয়নে কারও খননযন্ত্র নেই। তবে কৈয়ারবিলের আবুল কালাম ও উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের মুজিব নামের এক ব্যক্তি চট্টগ্রাম থেকে বেশ কিছু খননযন্ত্র এনেছেন। তাঁরা এসব খননযন্ত্র ভাড়া দিয়ে লোকজনকে মাটি কাটার সুযোগ করে দিচ্ছেন।
ইউপি সদস্য আনোয়ারা বেগম বলেন, ১৯৯০ সালের শেষ দিকেও খুদিয়ারটেকে লোকবসতি ছিল ৪০ হাজার। এখন কেউ নেই। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে খুদিয়ারটেকের অন্তত তিন হাজার একর ভূমি সাগরে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া সাগরে বিলীন হয়েছে ২টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়ণকেন্দ্র, ২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১২টি মক্তব-মাদ্রাসা, ৩০টি মসজিদ ও ১০ হাজার ঘরবাড়ি। খুদিয়ারটেকের বাস্তুহারা অন্তত ৩০ হাজার মানুষ মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন শত কিলোমিটার দূরের কক্সবাজার শহরে বিমানবন্দরের পশ্চিম পাশের সমুদ্র উপকূলীয় সরকারি জমিতে।
কুতুদিয়াকে ‘ক্লাইমেট হট স্পট’ উল্লেখ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ফাউন্ডেশনের প্রধান রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, প্রতিনিয়ত দুর্যোগের আঘাত, তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় উপকূলীয় মানুষের জীবন–জীবিকা হুমকিতে পড়েছে। সাগরগর্ভে বিলীন হতে হতে দ্বীপের আয়তন এখন ২৫ বর্গকিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। গত তিন দশকে ৬০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে দ্বীপ ছাড়লেও জমির পরিমাণ কমছে। সবুজবেষ্টনী সৃজন, টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ না নিলে সংকট আরও বাড়বে।
প্যারাবন উপকূল রক্ষাকবচ উল্লেখ করে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) কক্সবাজারের জেলা সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, প্যারাবন ধ্বংসের কারণে দ্বীপের বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এরপর ভাঙা বেড়িবাঁধ সংস্কারের নামে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা খরচ করা হলেও দুর্নীতির কারণে টেকসই বাঁধ হচ্ছে না। অন্যদিকে লবণের লোভে লোকজন প্যারাবনের দিকে হামলে পড়ছে।
প্যারাবনের জমিতে লবণ মাঠ তৈরি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপকূলীয় বন বিভাগ কুতুবদিয়ার রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক বলেন, প্যারাবনের পাশের ওই সব জমি বন বিভাগের নয়। দ্বীপে খননযন্ত্র কারা এবং কীভাবে নিয়ে এসেছেন, তা তিনি জানেন না।
খননযন্ত্র নিয়ে প্যারাবন নিধন ও সরকারি খাসজমিতে লবণ চাষ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ক্য থোয়াই প্রু মারমা প্রথম আলোকে বলেন, খাসজমিতে প্যারাবন নেই। খননযন্ত্র দিয়ে কোথাও মাটি কাটা হচ্ছে কি না, তা–ও জানা নেই। বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে এতগুলো খননযন্ত্র কুতুবদিয়াতে কারা এনেছে, তা–ও তিনি জানেন না।