বগুড়ায় ‘ঘুড়ি উৎসব’ যেন আকাশছোঁয়ার লড়াই

বগুড়া সদর উপজেলায় গতকাল ঐতিহ্যবাহী দাঁড়িয়াল মেলার অন্যতম আকর্ষণ নানা ধরনের ঘুড়ি। রোববার বিকেলে দাঁড়িয়াল গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

জমিনে জ্যৈষ্ঠ মাসে নানা মৌসুমি ফলের ম-ম গন্ধ। স্বচ্ছ, শুভ্র আসমানে নীলাকাশজুড়ে উড়ছে রংবেরঙের ঘুড়ি। বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আকাশে পত পত করে উড়ছে ঘুড্ডি, ডোল, চং, চিলা, বাক্স ঘুড়ি, মানুষ ঘুড়ি, বিমান ঘুড্ডিসহ বর্ণিল রঙের হরেক আকারের ঘুড়ি। নিচে নাটাই হাতে শিশু-কিশোরেরা। কার ঘুড়ি কত উঁচুতে উড়াতে পারে, চলছে সেই প্রতিযোগিতা। যেন আকাশছোঁয়ার লড়াই।

নীলাকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর লড়াইয়ের এ চিত্র রোববার বিকেলে কয়েক শ বছরের ঐতিহ্যবাহী বগুড়া সদরের নুনগোলা ইউনিয়নের দাঁড়িয়াল নিশানের মেলার। দাঁড়িয়াল গ্রামে শত বছর ধরে জ্যৈষ্ঠ মাসের দ্বিতীয় রোববার নিশানের এ মেলা বসছে। সাত দিনব্যাপী এ মেলায় হরেক রকম পণ্য কেনাবেচা হলেও ঘুড়ির জন্য প্রসিদ্ধ। এ কারণে দাঁড়িয়ালের মেলা ঘুড়ির মেলা নামেও পরিচিত। এবারও মেলায় জমে উঠেছে ‘ঘুড়ি উৎসব’। প্রথম দিনে রংবেরঙের হরেক রকমের বর্ণিল ঘুড়ি উড়িয়েছে শিশু-কিশোরেরা।

স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিদের ভাষ্য, ৪০০ বছর ধরে জ্যৈষ্ঠ মাসের দ্বিতীয় রোববার দাঁড়িয়াল গ্রামে এই মেলা বসছে। একসময় ‘নিশানা’ টাঙিয়ে লাঠিখেলার মাধ্যমে এই মেলা বসত। প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছে এই মেলা নিশানের মেলা নামে পরিচিত।

মেলা ঘিরে ঘরে ঘরে ধুম পড়েছে নানা মৌসুমি ফল দিয়ে জামাইবরণের। মেয়েরাও নাইওর এসেছেন বাবার বাড়িতে। ঘরে ঘরে আত্মীয়স্বজন এসেছেন মেলা উপলক্ষে নিমন্ত্রণ খেতে। এবার মেলায় লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটেছে। শিশু-কিশোরেরা মেলায় রংবেরঙের ঘুড়ি কিনে উৎসবে মেতেছে।

এবারের মেলায় সব রকমের ঘুড়ি মিলেছে ১০০ থেকে ৩০০ টাকায়। ঘুড়ি ওড়ানোর নাটাই ও সুতা বিক্রি হয়েছে মেলায় ৫০ টাকায়।

রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের বারপুর মোড় থেকে বগুড়া-দিনাজপুর সড়ক ধরে সামনে এগিয়ে হাজরাদীঘি তিনমাথা। সেখানে পৌঁছাতেই দেখা গেল, মেলা অভিমুখী মানুষের ঢল। সরু পথ ধরে কিছু দূর এগিয়েই দাঁড়িয়াল বাজার। বাজার থেকে মেঠো পথ ধরে আরও সামনে বিশাল এলাকাজুড়ে বসেছে নিশানের মেলা।

মেলায় নাগরদোলা, চড়কি, পুতুলনাচ থেকে শুরু করে বসেছে হরেক রকম পণ্যের সারি সারি দোকান। বসেছে বাঁশ ও মাটির তৈজসপত্র, হাতপাখা, তালপাখা, দা-বঁটি, নানা রকম খেলনা, প্রসাধনী, চুড়ি-ফিতা, আম, লিচু, বাঁশের বাঁশি, শিশুদের টমটম গাড়ি, মিঠাই মিষ্টান্ন, কদমা, ছাঁচ, মুড়িমুড়কি, দই-চিড়া, শরবত, জিলাপিসহ নানা পণ্যের দোকান। জমে উঠেছে কাঠের আসবাবের বেচাবিক্রিও।

সব ছাপিয়ে মেলায় আসা দর্শনার্থীদের মন কেড়েছে ঘুড়ি উৎসব। মেলার এক পাশে সারি সারি ঘুড়ি ও নাটাইয়ের দোকান নিয়ে বসেছেন দোকানিরা। রংবেরঙের ঘুড়ি আর নাটাই কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে শিশু-কিশোরেরা। কাগজ ও পলিথিনের বাহারি ঘুড়ি দেখতে ভিড় করেছেন বড়রাও।

হাজরাদীঘি চকপাড়া গ্রামের ঘুড়ি বিক্রেতা রিফাত সরকার বলেন, এবারের মেলায় ডোল, চং, মানুষ ঘুড়ি, চিলা, বাক্স, ঘুড্ডিসহ হরেক ঘুড়ি উঠেছে। এসব ঘুড়ি ১০০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

কলেজছাত্র ওবায়দুল হক রংবেরঙের ২১টি ঘুড়ি বিক্রির জন্য মেলায় এসেছেন। তিনি বলেন, ‘ঘুড়ি বিক্রি শেষ হলে লাভের টাকায় একটা মুরগি কিনব। বাকি টাকা বাবার হাতে দেব। বাবা পেশায় আখের রস বিক্রেতা।’

কাহালুর খেওয়াপাড়ার আজাদুল ইসলাম বলেন, ‘যেদিন থ্যাকে বুদ্ধি হচে, সেদিন থ্যাকেই নিশানের মেলাত আসিচ্চি। এই মেলাত আসলে ছোটকালের কথা খুব মনে পড়ে। যত দিন বেঁচে আছি, তত দিন এই মেলাত আসমো, ঘুড়ি-জিলাপি কিনে বাড়িত ফিরমো।’

ঘুড়ি দোকানি অন্তাহারের আবদুল হামিদ বলেন, এবার মেলায় ঘুড়ি-লাটাইয়ের শ খানেক দোকান বসিছে।

ঘুড়ি ব্যবসায়ী আবদুর রশিদ বলেন, ‘১০০ ঘুড়ি লিয়ে মেলাত আসচিলাম। সব বিক্রি হচে। এবার বেচাবিক্রি খুব ভালো।’

ঘুড়ির মেলায় নজর কেড়েছে বাহারি সব মিষ্টি। হরেক পদের মিষ্টি শোভা পাচ্ছে দোকানগুলোতে। বড় আকারের বালিশ ও মাছ মিষ্টি থেকে শুরু করে রসকদম, কুলফি, কালোজাম, পাতা মিষ্টি, ছানার জিলাপি, রসগোল্লা, মৌচাক, নাটিম, লাল কদম, পোটল, কাটি, হাসি-খুশি, কাটারিভোগ থেকে শুরু করে জিলাপি, কদমা, মতিচূড়ের লাড্ডু সবই আছে মেলায়। মেলায় ১০ কেজি ওজনের একটি মাছ মিষ্টি বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার টাকায়।

মিষ্টির দোকানি মিজানুর রহমান বলেন, নানা পদের মিষ্টি ২০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে এখানে। মেলায় বেচাবিক্রিও এবার বেশ ভালো।

জ্যৈষ্ঠ মাসে দাঁড়িয়াল মেলায় বসেছে হরেক রকমের ফলের দোকান। আছে পাকা আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, তরমুজ, তালের শাঁস থেকে শুরু করে নানা রকমের মৌসুমি ফল। দাঁড়িয়াল মেলার অন্যতম ঐতিহ্য এই ফল।

দাঁড়িয়াল গ্রামের জামাই প্রকৌশলী মিলন হোসেন বলেন, সারা বছর শ্বশুরবাড়িতে নিমন্ত্রণে না এলেও কেউ কিছু মনে করবেন না। তবে মেলা উপলক্ষে শ্বশুরবাড়ির দাওয়াতে না এলে খবর আছে!

দাঁড়িয়াল মেলা প্রসিদ্ধ কাঠের আসবাবের জন্য। এবারও কাঠের নানা আসবাবের বেচাবিক্রি জমে উঠেছে। তাজুল ইসলাম আদমদীঘি থেকে এসেছেন তাঁর আসবাব দোকান নিয়ে। তিনি জানান, এখনো এ বছর বেচাবিক্রি হয়নি। তবে সাত দিনের মেলায় আগামী দিনগুলো ভালোই বেচা হবে।

দাঁড়িয়াল বাজারের ব্যবসায়ী তসলিম উদ্দিন বললেন, ‘এই মেলায় লাঠির মাথায় চমর (চুল) বেঁধে একসময় নিশানা ওড়ানো হতো। চলত লাঠিখেলা। লোকে বলত, নিশানের মেলা। এখন বলে ঘুড়ির মেলা।