যেসব কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা

বরিশাল বিভাগের ৩১টি নৌপথের মধ্যে ২২টি স্থানে আছে নাব্যতা-সংকট। আবার অনেক স্থানে বয়া থাকলেও তাতে সংকেতবাতি জ্বলে না।

শীতে নৌপথে এমনিতেই বেশি কুয়াশা থাকে। সঙ্গে রয়েছে নাব্যতা-সংকট ও ডুবোচরের ঝুঁকি। এর মধ্যে নৌপথের অনেক স্থানে থাকে না সংকেতবাতি, ভাসমান বয়া ও মার্কার। এ ছাড়া নৌদুর্ঘটনা প্রতিরোধে তদন্ত কমিটি রোটেশন প্রথা বন্ধ করাসহ যেসব সুপারিশ করেছিল, সেসবও বাস্তবায়িত হয়নি। এসব কারণে দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।

বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০২১ সালে ২৩ ডিসেম্বর রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে। এদিন ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ নামের একটি লঞ্চে আগুন লাগে। ঘন কুয়াশার কারণে লঞ্চটি কিনারে নোঙর করাতে না পেরে মাঝনদীতে চালকবিহীন ভাসছিল। এতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৪৭ জন মারা যান। নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ৩১ জন।

লঞ্চের মাস্টার-চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা থেকে বরিশাল, ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালী, আমতলী, ভোলা, মেহেন্দীগঞ্জসহ বিভিন্ন নৌপথে বেশ কয়েকটি স্থানে ডুবোচর রয়েছে। এ ছাড়া বরিশাল বিভাগের ৩১টি নৌপথের মধ্যে ২২টি স্থানে আছে নাব্যতা-সংকট। শীতে তা তীব্র আকার ধারণ করে। আবার অনেক স্থানে বয়া থাকলেও তাতে সংকেতবাতি জ্বলে না।

জানতে চাইলে বরিশাল বিআইডব্লিউটিএর নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা গত মাসেও বেশ কিছু স্থানে মার্কার-বিকনবাতি স্থাপন করেছি। আরও যেসব স্থানে প্রয়োজন, দেওয়া হবে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। ভাসমান বয়ার জন্য নির্দিষ্ট জাহাজ প্রয়োজন। এ জন্য আমাদের দুটি জাহাজ আছে। এর একটি এখন মেরামতের জন্য ডকইয়ার্ডে। অন্যটি খুলনা অঞ্চলে কাজ করছে। কাজ শেষে এটা বরিশাল অঞ্চলে আসবে।’

* নৌদুর্ঘটনা প্রতিরোধে তদন্ত কমিটি যেসব সুপারিশ করেছিল, সেসবও বাস্তবায়িত হয়নি। * রোটেশন প্রথা এখনো বন্ধ হয়নি। একই সঙ্গে লঞ্চগুলোর অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জায় দাহ্য পদার্থ যেমন কাঠ, পারটেক্স এসব ব্যবহার হচ্ছে।

অভিযান-১০ লঞ্চের অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা রোধে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ২৫টি সুপারিশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘রোটেশন’ প্রথা বন্ধ করা। এ ছাড়া প্রধান প্রধান নদীবন্দর ছেড়ে যাওয়ার আগে নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও বিআইডব্লিউটিএর পরিদর্শকদের যথাযথভাবে যাত্রীবাহী লঞ্চ পরিদর্শন করা, ঘন ঘন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা, প্রয়োজনীয় জনবল বাড়ানো, লঞ্চের ইঞ্জিনকক্ষের আগুন নেভানোর জন্য স্থায়ী কার্বন ডাই-অক্সাইড সিস্টেম বাধ্যতামূলক করা, লঞ্চের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জায় দাহ্য পদার্থ ব্যবহার না করার পাশাপাশি ইঞ্জিন রুমের আশপাশে দাহ্য পদার্থ না রাখা, জরুরি নির্গমনপথ নিশ্চিত করা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

তবে দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে রোটেশন প্রথা এখনো বন্ধ হয়নি। একই সঙ্গে লঞ্চগুলোর অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জায় দাহ্য পদার্থ যেমন কাঠ, পারটেক্স এসব ব্যবহার হচ্ছে। পাশাপাশি অধিকাংশ লঞ্চে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার ঘাটতি এবং কর্মীদের নির্বাপণে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি।

চলতি বছরও কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত ৭ জানুয়ারি দিবাগত ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঢাকা থেকে বরগুনার উদ্দেশে ছেড়ে আসে এমভি অথৈ-১ লঞ্চ। ঘন কুয়াশার কারণে লঞ্চটি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার মগর ইউনিয়নের নদীর চরে আটকে যায়। সর্বশেষ গত ২৯ জানুয়ারি দিবাগত রাতে ঢাকা থেকে ভোলা আসার পথে মেহেন্দীগঞ্জ–সংলগ্ন কালাবদর নদের চর শেফালি এলাকায় এমভি প্রিন্স অব রাসেল নামের একটি লঞ্চ ঘন কুয়াশায় অপর একটি জেলে নৌকাকে ধাক্কা দেয়। এতে নৌকাটি ভেঙেচুরে এর দুই জেলে নিখোঁজ হয়। এর ঠিক আগের দিন রাতে হিজলাসংলগ্ন আড়িয়াল খাঁ নদে একটি খেয়ানৌকাকে একটি বাল্কহেড ধাক্কা দেয়। এতে খেয়ানৌকার এক যাত্রী মারা যান।

ডুবোচর অপসারণে তাঁদের ড্রেজিং চলমান রয়েছে উল্লেখ করে বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ সেলিম আরও বলেন, ‘নৌপথে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন স্থানে সংকট তৈরি হয়। এটা প্রাকৃতিক কারণেই ঘটে। প্রতিবছর নদীগুলো গতিপথ ও ডুবোচর নানাভাবে পরিবর্তিত হয়ে সংকট সৃষ্টি করে। এ জন্য হিজলা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত নৌপথে বড় ধরনের একটি হাইড্রোলিক জরিপ হচ্ছে। জরিপ শেষে আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হবে।’

তবে নৌপথে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বিআইডব্লিউটিএর ঘাটতি দেখছেন বরিশালে নৌযাত্রী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক দেওয়ার আবদুর রশিদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নৌপথে চরম অব্যবস্থাপনা আমরা দূর করতে পারিনি। আবার প্রতিনিয়ত নদীগুলোর চরিত্র প্রাকৃতিক ও জলবায়ুগত কারণে পরিবর্তন হচ্ছে।’

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্র জানায়, ঢাকার সদরঘাট থেকে ৪৪টি নৌপথে প্রতিদিন ২২১টির মতো লঞ্চ চলাচলের অনুমতি থাকলেও প্রতিদিন গড়ে চলাচল করে ৮৫টি। এই বিভাগে নৌপথ রয়েছে ১ হাজার ৪৭৫ কিলোমিটার।

নৌযানের চালকেরা জানিয়েছেন, বরিশালের হিজলা চরের এলাকাটি ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে নাব্যতা–সংকটের কারণে প্রায়ই লঞ্চ ও কার্গো আটকে থাকে। মেহেন্দীগঞ্জের শ্যাওড়া থেকে উলানিয়া পর্যন্ত সংকেতবাতি না থাকায় এলাকাটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। মেঘনার মাঝের চরে ডাউনে ডুবোচরে বয়াবাতি নেই। উলানিয়া চরেরটেকে বয়াবাতি দরকার।

ঝালকাঠি থেকে বরগুনা চ্যানেলে ঢোকার পথে চল্লিশ কাউনিয়ার বাঁ পাড়ে চরের মাথায় মার্কার ও সংকেতবাতি কিছুই নেই। এই পথে কাঁঠালিয়া উপজেলায় হদুয়ার ডান পাড়ে বিষখালী নদীর চরের মাথায়ও নেই কোনো সংকেতবাতি। এ ছাড়া বাকেরগঞ্জের নিয়ামতি ঘাটের ডানে-বাঁয়ে, নিয়ামতি থেকে বরগুনার বেতাগী পর্যন্ত বিষখালী নদীতে কোনো মার্কার ও সংকেতবাতি নেই। একই অবস্থা ঢাকা-ভোলা নৌপথের। মেঘনা নদীর ইলিশার আগে বঙ্গেরচরে জরিপ করে বয়াবাতি দেওয়া দরকার। শ্রীপুরে বয়া আছে, সংকেতবাতি নেই।

বরিশাল-ঢাকাগামী এমভি সুন্দরবন-১১ লঞ্চের মাস্টার মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা-বরিশাল পথের অধিকাংশ লঞ্চ নতুন প্রজন্মের হওয়ায় এসব লঞ্চে রাডার, ইকো সাউন্ডারসহ আধুনিক দিকনির্ণয় যন্ত্র রয়েছে। এ কারণে এ নৌপথে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কম। তবে অন্যান্য পথে চলাচলকারী কোনো লঞ্চের অপারেটিং ও ট্রাফিক সিস্টেম আধুনিক নয়। ফলে এসব লঞ্চের চালকেরা একরকম আন্দাজের ওপর ভর করে চলাচল করেন।