শ্রমিকদের অনুদানের টাকা ইউপি সদস্য ও পঞ্চায়েতের সভাপতির পকেটে

চা বাগানফাইল ছবি: প্রথম আলো

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল চা-বাগানে এককালীন সরকারি অনুদান বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। ২৪৯ শ্রমিককে ছয় হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা থাকলেও বিতরণের তালিকায় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য, শ্রমিক পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি ও তাঁদের পরিবারের একাধিক সদস্যের নাম পাওয়া গেছে।

উপজেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি সম্প্রতি এসব অনিয়মের সত্যতা নিশ্চিত করেছে। অনুদান বিতরণে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে সম্প্রতি বরমচাল ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন কয়েকজন চা–শ্রমিক। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৬ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য সাহানুর রহমানকে প্রধান করে ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে তদন্তের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, তালিকায় নাম তুলতে শ্রমিকদের কাছ থেকে উৎকোচ নেওয়া হয়েছে। আবার কারও নাম তালিকায় থাকলেও তাঁরা টাকা পাননি, অন্যদিকে তালিকায় নাম না থাকা একাধিক ব্যক্তি এ অনুদান পেয়েছেন।

উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় ও শ্রমিকদের সূত্রে জানা গেছে, চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে উপজেলার বিভিন্ন চা-বাগানের পাঁচ হাজার স্থায়ী শ্রমিককে এককালীন ছয় হাজার টাকা করে আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়। বরমচাল চা-বাগানের মোট ২৪৯ শ্রমিকের নামে এই অনুদানের টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কথা ছিল, তাঁদের প্রত্যেকের বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠানো হবে।

তদন্ত কমিটি জানায়, তাঁরা ২৪৯ জন উপকারভোগী শ্রমিকের মধ্যে ১৮৭ জনের সঙ্গে তাঁরা সরাসরি কথা বলেছে। উপকারভোগীদের তালিকায় ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য চন্দন কুর্মী, তাঁর স্ত্রী বিনা কুর্মী, বাগানের শ্রমিক পঞ্চায়েতের সভাপতি আগনু দাস, তাঁর স্ত্রী সাবিত্রী দাস, তাঁদের ছেলে সাগর দাস ও প্রবাসী সুমন দাসের নাম আছে। এমন আরও ২৪টি সচ্ছল পরিবারের একাধিক সদস্যের নাম তালিকায় পাওয়া যায়।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তালিকায় নাম দেওয়ার কথা বলে ৮৫ ভাগ শ্রমিকের কাছ থেকে ২০০, ৩০০, ৫০০, ৮০০ ও ২ হাজার টাকা করে উৎকোচ নেওয়া হয়েছে। বাগানের শ্রমিক নন এমন চারজনের নাম আছে এ তালিকায়। তালিকাভুক্ত ৯ জন উপকারভোগীর জাতীয় পরিচয়পত্র সঠিক থাকলেও তাঁদের বিকাশ নম্বর ভুল। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত ৩৬ জন উপকারভোগী অনুদানের কোনো টাকা পাননি।

প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, তালিকায় নাম দেওয়ার আশ্বাসে দেওন্তী রাজগড় নামের এক শ্রমিকের কাছ থেকে ২ হাজার টাকা ঘুষ নেন ইউপি সদস্য চন্দন কুর্মী। তালিকায় তাঁর নাম থাকলেও বিকাশ নম্বরটি ভিন্ন ছিল। সুজন ও মিঠুন দাস নামের দুই শ্রমিকের নাম তালিকায় নেই। কিন্তু তাঁদের বিকাশ নম্বরে ৬ হাজার টাকা করে অনুদান এসেছে। পরে পঞ্চায়েত সভাপতি আগনু তাঁদের কাছ থেকে সিংহভাগ টাকা নিয়ে যান। উপকারভোগীদের বক্তব্যের ভিডিও সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে চন্দন কুর্মী ও আগনু দাস দাবি করেন, নতুন করে উপকারভোগীদের তালিকা হয়নি। সমাজসেবা কার্যালয়ে উপকারভোগীদের পুরোনো তালিকা ছিল। ওই তালিকা অনুযায়ী অনুদান দেওয়া হয়। আগের তালিকায় তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নাম ছিল। তবে তালিকায় নাম তুলতে ঘুষ ও অনুদানের টাকায় ভাগ বসানোর অভিযোগ অস্বীকার করে বিষয়টিকে ‘প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র’ বলে উল্লেখ করেছেন।

চন্দন ও অগনুর দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা প্রাণেশ বর্মা। তিনি বলেন, বরমচালসহ সব চা-বাগান থেকে পাওয়া উপকারভোগীদের নতুন তালিকা অনুযায়ী অনুদান দেওয়া হয়। চা–বাগানের শ্রমিক পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বাগানের ব্যবস্থাপকের সমন্বয়ে এ তালিকা তৈরি করা হয়।

এদিকে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে ইউএনও মহিউদ্দিন আজ শুক্রবার সকালে মুঠোফোনে বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।