সাতক্ষীরার মানুষ সুন্দরবন সুরক্ষায় বদ্ধপরিকর। সুন্দরবন না থাকলে উপকূলীয় এলাকার মানুষদের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। এ জন্য সুন্দরবন রক্ষায় যুগোপযোগী আইন করতে হবে। আগামী নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে সুন্দরবন ও উপকূলীয় এলাকার উন্নয়নের জন্য ‘সুন্দরবন উন্নয়ন’ নামে পৃথক মন্ত্রণালয়ের প্রতিশ্রুতি নিতে হবে।
সাতক্ষীরায় ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিতকরণে নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ কথা বলেন। পাশাপাশি আগামী জাতীয় নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে জাতীয় সংসদে নারীদের আসন বৃদ্ধি করে ১০০ করা; পেশিশক্তি, কালো টাকার ব্যবহার ও মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ করা; সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক মানুষের স্বার্থ রক্ষা; স্বচ্ছ ভাবমূর্তির প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি বক্তারা আহ্বান জানান।
সাতক্ষীরা জেলা সদরের লেকভিউ মিলনায়তনে বেলা ১১টায় শুরু হয় জেলা পর্যায়ের এ গোলটেবিল বৈঠক। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় একশনএইডের সুশীল প্রকল্পের অধীন সাতক্ষীরার ভূমিজ ফাউন্ডেশন এ বৈঠকের আয়োজন করে। এ আয়োজনে প্রচার সহযোগী হিসেবে রয়েছে প্রথম আলো।
আগামী নির্বাচনে ভোটাররা স্থানীয় সমস্যাগুলোর সমাধানের প্রতিশ্রুতি চান উল্লেখ করে গণফোরামের সাতক্ষীরা জেলা সভাপতি আলী নূর খান বলেন, সাতক্ষীরা জেলা সুন্দরবনঘেঁষা। এ জেলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। এ দুর্যোগ থেকে বাঁচাতে সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জেলার মানুষ মনে করে, সুন্দরবন বাঁচলে এই উপকূলের মানুষ বাঁচবে। এ জন্য সুন্দরবন রক্ষায় নতুন আইন দরকার। পাশাপাশি সুন্দরবন উন্নয়নের জন্য ‘সুন্দরবন উন্নয়ন’ নামে পৃথক মন্ত্রণালয় দরকার।
গোলটেবিল বৈঠকে একই দাবি তুলে ধরেন বেসরকারি সংস্থা রূপালীর নির্বাহী পরিচালক শফিকুল ইসলাম ও পল্লী চেতনার নির্বাহী পরিচালক আনিছুর রহমান।
নির্বাচনে কালো টাকার ব্যবহার ও মনোনয়ন–বাণিজ্য দূর করতে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি প্রবর্তনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন জামায়াতে ইসলামীর সাতক্ষীরা জেলা আমির উপাধ্যক্ষ শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, জাতীয় সংসদে নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ চালু করতে হবে। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভোটারদের মূল্যায়ন হয়। রাজনীতিবিদ ছাড়াও পিআর পদ্ধতিতে যোগ্য ব্যক্তিদের প্রার্থী হওয়ার ও নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। সেখানে যোগ্য নারীরাও যুক্ত হতে পারেন। সর্বোপরি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড।
পিআর পদ্ধতির সমালোচনা করে বক্তব্য দেন সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক সৈয়দ ইফতেখার আলী। বিদ্যমান ব্যবস্থাতেই আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পিআর পদ্ধতি সঠিকভাবে প্রার্থী যাচাই–বাছাইয়ের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। একজন প্রার্থীকে চিনলাম না, জানলাম না, অথচ তাঁকে ভোট দিতে হবে। এটা আমাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না।’
গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশের সমাজতন্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও গণফোরামের জেলা পর্যায়ের নেতারা বক্তব্য দেন। তাঁরা জাতীয় সংসদে বর্তমান ৩০০ আসনের সঙ্গে নারীদের জন্য অতিরিক্ত ১০০ আসন যুক্ত করে সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচনসহ বিভিন্ন প্রস্তাব রাখেন।
গত নির্বাচনে ২০ হাজার টাকায় প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করা গেলেও এবার তা ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে উল্লেখ করে বাসদের জেলা সংগঠক আজাদ হোসেন জানান, প্রার্থীদের ব্যয়ও অনেক বাড়ানো হয়েছে। একজন স্বচ্ছ ও যোগ্য শিক্ষক যদি নির্বাচনে অংশ নিতে চান, তিনি কীভাবে এত টাকার সংস্থান করবেন? ফলে ধনী শ্রেণিদের হাতে নির্বাচন জিম্মি হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো অবস্থায় সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছাড়ায়, এমন বক্তব্য দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে এ জন্য আইন করতে হবে। শাস্তির বিধান রাখতে হবে।
সিপিবির সাতক্ষীরা জেলা সভাপতি আবুল হোসেন বলেন, বাহাত্তরের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে হলে ভোটারদের আস্থায় আনতে হবে। সংখ্যালঘুসহ সব শ্রেণি–পেশার মানুষ যাতে নির্ভয়ে নির্বাচনকেন্দ্রে যেতে পারে ও ভোট দিতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এমন নির্বাচন হতে যাতে গণমানুষের আশা পূরণ হয়।
আগামী জাতীয় নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, সে জন্য সবাইকে সহযোগিতা ও ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য ভারতেশ্বরী বিশ্বাস। তিনি বলেন, নারী ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যাতে সুষ্ঠুভাবে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারে এবং ভোট দিতে পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা সহসভাপতি অধ্যক্ষ পবিত্রমোহন দাশ বলেন, ভোটারদের আস্থা ফিরিয়ে এনে ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে যেমন পক্ষপাতমুক্ত থাকতে হবে, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করতে হবে। উভয়ের সমন্বয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে।
গোলটেবিল বৈঠকের শুরুতে নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি ও সংস্থাগুলোর দেওয়া জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সুপারিশ তুলে ধরেন সিএসও প্রতিনিধি ইমদাদুল হক। প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরীর সঞ্চলনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন একশনএইড বাংলাদেশের উইমেন রাইটস অ্যান্ড জেন্ডার ইকুইটি বিভাগের প্রধান মরিয়ম নেছা।
গোলটেবিল বৈঠকে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন এডাবের জেলা সভাপতি মাধব চন্দ্র দত্ত, প্রথম আলোর সাতক্ষীরার নিজস্ব প্রতিবেদক কল্যাণ ব্যানার্জি, সাতক্ষীরা জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি আবুল কালাম (বাবলা), ভালুকা চাঁদপুর আদর্শ কলেজের অধ্যক্ষ মোবাশ্বেরুল হক, সাতক্ষীরা পাবলিক লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান রাসেল প্রমুখ।