মুড়ি ভাজার ব্যস্ততা সখীপুরের ৪ গ্রামে

হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা থাকে সারা বছর। রোজায় চাহিদা পাঁচ গুণ বাড়ে। ফলে এ মাসে বাড়ে মুড়ি ভাজার ব্যস্ততা।

মুড়ি বাজায় ব্যস্ত এক নারী। সারা বছরই এমন দৃশ্য দেখা যায় টাঙ্গাইলের সখীপুরের চারটি গ্রামে। রোজায় এ ব্যস্ততা আরও বাড়েপ্রথম আলো

মুড়ি ছাড়া ইফতার ভাবাই যায় না। সেই মুড়ি যদি হয় হাতে ভাজা, তাহলে তো কথাই নেই। পবিত্র রমজান উপলক্ষে হাতে ভাজা মুড়ির কয়েক গুণ চাহিদা বেড়েছে। এই চাহিদার কথা ভেবে টাঙ্গাইলের সখীপুরের চারটি গ্রামে গড়ে উঠেছে হাতে ভাজা মুড়ির কারখানা। ওই চার গ্রামের স্বল্প আয়ের শতাধিক পরিবার মুড়ি বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছে। এই হাতে ভাজা মুড়ি সখীপুর উপজেলার মানুষের চাহিদা মিটিয়ে জেলা শহর টাঙ্গাইল ও রাজধানী ঢাকাতেও পাঠানো হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার কইয়ামধু, বেড়বাড়ী, রতনপুর ও কালীদাস গ্রামকে অনেকেই মুড়ির গ্রাম হিসেবেই চেনেন। গত বুধবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে উপজেলার কালীদাস গ্রামের মন্দিরপাড়া এলাকার কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁরা কোনো রাসায়নিক পদার্থ ছাড়াই মুড়ি ভাজছেন।

ওই গ্রামের পদ্মা রানী সরকার তাঁর নবম শ্রেণিতে পড়া ছেলে নিলয় সরকারকে নিয়ে চুলায় মাটির হাঁড়িতে মুড়ি ভাজছিলেন। দেখা গেল, একটি চুলায় পদ্মা রানী চালের সঙ্গে লবণের পানি মিশিয়ে ভাজছেন। আরেকটি চুলায় ছেলে বড় একটি হাঁড়িতে বালু গরম করছে। চাল ভাজা হলে ওই গরম বালুর হাঁড়িতে গরম চাল ঢেলে দেওয়া হয়। পদ্মা রানী তখন বালুর হাঁড়িটি ঘোরাতে থাকেন। ৩০ সেকেন্ডের ভেতর সেই হাঁড়িতে চাল ফুটে মুড়িতে রূপ নেয়। সঙ্গে সঙ্গে হাজার ফোঁড়ের একটি হাঁড়িতে (স্থানীয় ভাষায় ঝাঞ্জর) বালুসহ মুড়ি ঢেলে দেওয়া হয়। ওই ঝাঞ্জরে মুড়ি আটকা পড়ে আর বালু ফোঁড়ের ভেতর দিয়ে নিচের পাতিলে ঝরে পড়ে। এভাবেই হাতে ভাজা মুড়ি তৈরি হয়।

পদ্মা রানীর বাড়ির পূর্ব পাশে আলো রানীর বাড়ি। ওই বাড়িতে দেখা যায়, স্বামী জলধর সরকারকে নিয়ে ৫০ বছর বয়সী আলো রানী একই কায়দায় মুড়ি ভাজছেন। আলো রানী জানান, স্বামী অসুস্থ, অন্য কোনো কাজ করতে পারেন না। মুড়ি ভেজেই চলে তাঁদের চারজনের সংসার।

বুধবার দুপুরে উপজেলার কইয়ামধু গ্রামের এসহাক ও কামাল হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ওই বাড়িতেও হাতে ভাজা মুড়ি তৈরি হচ্ছে। কামালদের বাড়ির পাশেই আলাউদ্দিনের বাড়ি। ওই বাড়িতে গিয়েও দেখা যায়, স্ত্রী ফাহিমা আক্তারের সঙ্গে আলাউদ্দিন মুড়ি ভাজছেন। স্বামী মুড়ির চাল ভাজছেন আর স্ত্রী বালুর পাতিল গরম করছেন। এভাবে দুজন মিলেমিশে মুড়ি ভাজার কাজ করছেন।

আলাউদ্দিন বলেন, রমজান মাস এলেই হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা বাড়ে। রোজার আগে কমপক্ষে ১০ মণ মুড়ি ঢাকার কারওয়ান বাজারের এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেছেন। ট্রাকে করে ব্যবসায়ীরা গ্রাম থেকে ৫০ মণ মুড়ি নিয়ে গেছেন। ফাহিমা আক্তার জানান, ২ মণ চালের মুড়ি ভাজতে ১ কেজি লবণ, ৫০০ টাকার লাকড়ি খরচ হয়। ১ কেজি মুড়ি তৈরিতে তাঁদের খরচ হয় ৮০ টাকা। বাড়ি থেকে ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করা হয়। তবে যে পরিশ্রম হয়, তাতে টাকায় পোষায় না।

কইয়ামধু গ্রামের ফরিদ মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ওই গ্রামের ফিরোজা নামের এক গৃহবধূ ঢাকায় থাকেন। স্বামী পুলিশে চাকরি করেন। তিনি গ্রামে বেড়াতে এসেছেন। ওই গৃহবধূ নিজে মুড়ি ভাজা দেখে কিনে নিয়ে যেতে ওই বাড়িতে এসেছেন। ফিরোজা আক্তার বলেন, ‘ঢাকার বাজারে সবকিছুতেই ভেজাল. কিন্তু আমার দেখা এই মুড়িতে কোনো ভেজাল নেই। দামও কম। তাই এক বস্তা কিনে নিয়ে যাচ্ছি।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১ কেজি চালে ৮৫০ গ্রাম মুড়ি হয়। ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত একটানা মুড়ি ভেজে গেলে এক দিনে প্রায় দুই মণ চালের মুড়ি ভাজা যায়। দিনে দুজন মিলে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা আয় করা যায়। এই টাকায় তেমন পোষায় না। উপজেলার বেড়বাড়ী গ্রামের আবদুর রশিদ ও ঘুঘুর আলী জানান, আগে তাঁরাও মুড়ি ভাজার ব্যবসা করতেন। এ ব্যবসায় পরিশ্রম বেশি, লাভ কম। এখন তাঁরা ঘোড়ার গাড়ি চালান। তাঁদের মতো অনেকেই মুড়ি ভাজার ব্যবসা ছেড়ে অন্য পেশায় যোগ দিচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কইয়ামধু গ্রামে ৩০টি, বেড়বাড়ীতে ১৮, রতনপুরে ৩৫, কালীদাস গ্রামে ২৫টি স্বল্প আয়ের পরিবার মুড়ি ভাজার পেশা সঙ্গে জড়িত। সখীপুর বাজারের তমিজ উদ্দিন নামের এক মুড়ি ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা সারা বছর থাকলেও রমজান মাসে এর পাঁচ গুণ চাহিদা বাড়ে। ফলে এ মাসে লাভ হয় একটু বেশি। কিন্তু অন্য মাসে চাহিদা তেমন না থাকায় অনেকেই মুড়ি ভাজার কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।