লোকসানে খামারিরা মুরগি পালন ছেড়ে দিচ্ছেন

জেলা পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন সূত্রমতে, বর্তমানে প্রান্তিক পর্যায়ে ৫০টি লেয়ার মুরগির খামার চালু রয়েছে।

লোকসানের কারণে দুই মাস আগে বন্ধ হয়ে গেছে মুরগির খামারটি। গতকাল রংপুর শহরতলির উত্তম বানিয়াপাড়া এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

রংপুরে মুরগির খামার ক্রমেই কমছে। খাবার ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এবং বড় বড় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে লোকশানের মুখে পড়ে মুরগি পালন ছেড়ে দিচ্ছেন খামারিরা।

জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর সূত্র জানা যায়, জেলায় নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত লেয়ার মুরগির খামারের সংখ্যা ৬৫৩টি। কিন্তু চালু হওয়ার পর খামারিদের বর্তমান অবস্থা কোন পর্যায়ে রয়েছে, এসব নিয়ে তাদের দপ্তরে কোনো তথ্য নেই। তবে জেলা পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন সূত্রমতে, বর্তমানে প্রান্তিক পর্যায়ে ৫০টি লেয়ার মুরগির খামার চালু রয়েছে।

পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৫-৯৬ সালে রংপুরে ছোট ছোট খামারে মুরগি পালন শুরু হয়। ব্যবসা ভালো হওয়ায় ২০০৪ সালের দিকে ব্যাপকহারে খামারভিত্তিক মুরগি পালন শুরু হয়। সে সময় ৫০ হাজারের অধিক মুরগির খামার গড়ে ওঠে। কিন্তু ২০০৭ সালে মহামারি হিসেবে দেখা দেয় অ্যাভিয়াম ফ্লু, যার প্রভাব পড়ে পোলট্রিশিল্পে। ধীরে ধীরে কমতে থাকে খামার। এরপরও টিকে থাকার চেষ্টা করেন বেশ কিছু খামারি। এদিকে ২০১৯ সাল থেকে পোলট্রি খাদ্যের ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় এ শিল্পে নতুন করে নেমে আসে বিপর্যয়।

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের মহব্বত আলীর মুরগির খামারে প্রায় আট হাজার লেয়ার মুরগি ছিল। এই মুরগির মাধ্যমে উৎপাদন করতেন ডিম। কিন্তু মুরগির খাদ্য ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে লোকসানের মুখে পড়েন। তিনি বলেন, লোকশানে পড়ে এক বছরের বেশি সময় হলো খামার বন্ধ করে দিতে হয়েছে।

সিটি করপোরেশনের নজিরের হাট এলাকার খামারি ফিরোজ মিয়ার মুরগি ছিল তিন হাজার। খাদ্যসহ বিভিন্ন উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেড় বছর হলো তাঁর খামারও বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, মুরগির খাদ্যের দাম বাড়ছে ঠিকই। এরপরও বড় বড় খামারিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যবসায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। লোকশানে পড়ে খামার বন্ধ করে দিতে হয়েছে।

খাবার ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে বিরূপ আবহাওয়াও মুরগির খামারিদের বিপদ ডেকে আনে। গত তিন-চার মাস আগে প্রচণ্ড গরমে খামারে মুরগি মারা যেতে শুরু করে। ওই সময় নগরীর বোতলা এলাকার খামারি বেলায়েত হোসেনের আট হাজার মুরগির মধ্যে দেড় হাজারের বেশি মুরগি মারা যায়।

এ ছাড়া অতিরিক্ত গরমে পীরগাছা উপজেলার সাতদড়গাহ গ্রামের খামারি আবু হাশেমের ১০ হাজার মুরগির প্রায় ১ হাজার, গঙ্গাচড়া উপজেলার মৌলভীবাজার এলাকার খামারি আবু বক্করের ৬ হাজার মুরগির প্রায় ৭০০ মারা যায়। এমন পরিস্থিতিতে লোকশানের বোঝা না বাড়াতে তাঁরা খামার বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন বলে জানিয়েছেন।

পোলট্রি ব্যবসায়ীরা জানান, এক থেকে দেড় বছরের ব্যবধানে মুরগির খাবারের দাম ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক বছর আগে ৫০ কেজির খাবারের বস্তার দাম ছিল ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা। বর্তমানে ১ হাজার ২০০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৪০০ টাকা।

রংপুর জেলা পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আরমানুর রহমান জানান, মুরগির খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়াসহ বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে টিকতে না পেরে জেলায় পোলট্রি খামার কমে গেছে। এখন খামারের সংখ্যা ৫০টিতে নেমে এসেছে। প্রান্তিক খামারিদের এখন একটি ডিম উৎপাদন করতে খরচ হচ্ছে ১০ দশমিক ২০ টাকা। তবে করপোরেট কোম্পানিগুলো একসঙ্গে অনেক ডিম উৎপাদন করায় তাদের খরচ তুলনামূলক কম হয়।

আরমানুর রহমান আরও বলেন, একসময় রংপুরের বাজারে ডিমের চাহিদা মেটাতেন জেলার ব্যবসায়ীরা। এখন সেটি চলে গেছে বড় ব্যবসায়ীদের কাছে। বর্তমানে জেলায় প্রতিদিন ডিমের চাহিদা প্রায় ১০ লাখ। এর মধ্যে মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ ডিম সরবরাহ করছেন প্রান্তিক খামারিরা। বাকি ডিম সরবরাহ করছে করপোরেট কোম্পানিগুলো।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন রংপুর বিভাগের সমন্বয়কারী মাহবুব আলম বলেন, পোলট্রি খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকা এবং করপোরেট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় জেলা পর্যায়ে খামারির সংখ্যা একেবারে কমে এসেছে। একসময় ভুরাঘাটে তাঁর খামারে ১৬ হাজার মুরগি ছিল। কিন্তু অব্যাহত লোকসানে বর্তমানে মুরগির সংখ্যা নেমে এসেছে চার হাজারে। এ অবস্থায় খামার টিকিয়ে রাখা কষ্টকর হয়ে উঠেছে।