ঘড়ির কাঁটায় তখন সময় বেলা একটা। বাবার লাশের অপেক্ষায় বসতবাড়িতে টিনের ঘরের বারান্দার সিঁড়িতে বসে ছিলেন পাপিয়া আক্তার (২৬)। সন্তানের লাশের অপেক্ষায় ছিলেন বৃদ্ধ মা-ও। তাঁদের দুই চোখ ছলছল করছিল। বাড়িতে তখনো আত্মীয়স্বজন এসে পৌঁছাননি। তাঁদের সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন প্রতিবেশী কয়েকজন নারী। কিছুক্ষণ পরই আসতে শুরু করেন স্বজনেরা। এ সময় ফুফুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন পাপিয়া। আহাজারি করে বলছিলেন, ‘আমার কী হয়ে গেল...! আমি এতিম হইয়্যা গেলাম রে ফুফু...। আমার বাবা আর নাই রে ফুফু...।’
মানিকগঞ্জে স্কুলবাসে অগ্নিসংযোগে দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া চালক পারভেজ খানের (৪৫) বাড়িতে গিয়ে এই দৃশ্য দেখা যায়। তাঁর বাড়ি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার ভাড়াই-ভিকরা গ্রামে।
আজ সোমবার সকাল পৌনে ৯টার দিকে ঢাকায় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। দুপুর পর্যন্ত তাঁর লাশ হাসপাতাল থেকে বাড়িতে পৌঁছায়নি। লাশের সঙ্গে হাসপাতালে পারভেজের স্ত্রী নার্গিস আক্তার ও ছেলে সুমন খান রয়েছেন।
পারভেজের স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে এবং বৃদ্ধ মা রয়েছেন। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে পুরো পরিবারটি। পারভেজের এমন মৃত্যুতে প্রতিবেশীদের মধ্যেও শোক বইছে। কথা হয় প্রতিবেশী শামীম হোসেন খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রায়ের আগে সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন স্থানে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আসছেন। পারভেজের হত্যার ঘটনায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
শিবালয় থানা-পুলিশ এবং মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, জেলা শহরে দি হলি চাইল্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের বাসে করে স্কুলে আনা-নেওয়া করা হয়। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মহাসড়কের পাশে উপজেলার ফলসাটিয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ফুটওভার সেতুর নিচে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি বাস পার্কিং করে রাখা হয়। এ সময় চালক পারভেজ বাসের ভেতরে ঘুমিয়ে পড়েন। এদিন রাত দেড়টার দিকে দুর্বৃত্তরা হঠাৎ বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দিলে মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় বাসের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা চালক পারভেজ গুরুতর দগ্ধ হন।
পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য চালক পারভেজকে ঢাকায় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। আজ সোমবার সকাল পৌনে ৯টার দিকে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
নিহত পারভেজের মেয়ে পাপিয়া আক্তার বলেন, ‘আমার আব্বা কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না, সাধারণ একজন ড্রাইভার ছিল। পরিকল্পনা কইর্যা বাসে আগুন দিয়া আমার আব্বুরে মারা হইচে। আমাগো সংসারে আমার আব্বুই একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ ছিল। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’
ছেলে অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর থেকেই খাওয়াধাওয়া করছেন না বৃদ্ধ মা রেহেনা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার পুলারে (ছেলেকে) পুড়াইয়্যা মারছে। সিগারেটের আগুন না, মশার কয়েলের আগুনও না, গাড়িতে আগুন দিয়্যা মারছে। আমি এর বিচার চাই।’
এ ঘটনায় বাসের মালিক মো. আশরাফুল ইসলাম থানায় মামলা করেছেন। শিবালয় থানা সূত্রে জানা গেছে, এ অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গত শুক্রবার রাতে বাসের মালিক অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে শিবালয় থানায় মামলা করেছেন। এ মামলায় এ পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের শিবালয় উপজেলার উলাইল ইউনিয়ন কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক জাকারিয়া আলম (২১), মহাদেবপুর ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সহসভাপতি মজিবুর রহমান (৫৫), মহাদেবপুর ইউনিয়ন যুবলীগের কোষাধ্যক্ষ আরমান আলী (৪৫), মহাদেবপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাবজাল হোসেন (৪৮), উলাইল ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আলতাফ হোসেন (৪৫)।
শিবালয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এম আমান উল্লাহ বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ সকালে দগ্ধ বাসচালক মারা গেছেন। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। বাসমালিকের দায়ের করা মামলাটি হত্যা মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করা হবে।