ঝুপড়ি থেকে ফ্ল্যাটবাড়ির মালিক হচ্ছে আরও ২৫০০ পরিবার

কক্সবাজারের খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পে তৈরি হচ্ছে পাঁচতলা আরও ৬০টি ভবন। এসব ফ্ল্যাটে ঠাঁই হবে জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারের সদস্যদের। ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়ে উপকারভোগীদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। গত বুধবার বিকেলে তোলা ছবি
প্রথম আলো

কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর পূর্ব-উত্তর তীরে খুরুশকুল এলাকা। সেখানে অধিগ্রহণ করা ২৫৩ দশমিক ৩৫০ একর জমিতে গড়ে উঠছে ১৩৭টি পাঁচতলা ভবনের বিশেষ ‘খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্প’। এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ অগ্রাধিকার প্রকল্প। প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে।

এই প্রকল্পের দুই বছর আগে প্রথম ধাপে তৈরি ২০টি ভবনে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে ৬০০ জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারের। দ্বিতীয় ধাপে আরও আড়াই হাজার পরিবারকে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে প্রস্তুত করা হচ্ছে আরও ৬০টি ভবন। এ নিয়ে উপকূলে মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রামু ১০ পদাতিক ডিভিশন। জেলা প্রশাসন সূত্রে এ তথ্য জানিয়েছে।
গত বুধবার সরেজমিনে দেখা গেছে, পাঁচতলা প্রতিটি ভবনে ৬৫০ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট থাকছে ৩২টি। এ ক্ষেত্রে ১৩৭টি ভবনে ফ্ল্যাট হবে ৪ হাজার ৩৮৪টি। বিনা মূল্যেই এই ফ্ল্যাটের মালিক হচ্ছেন জলবায়ু উদ্বাস্তুরা। ফ্ল্যাটের জন্য ২০১১ সালে তালিকাভুক্ত করা হয় ৪ হাজার ৪০৯টি পরিবারকে।

২০২০ সালের ২৩ জুলাই গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রথম ধাপে তৈরি ২০টি পাঁচতলা ভবনের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময় প্রায় ৬০০ পরিবারের হাতে ফ্ল্যাটের চাবি হস্তান্তর করা হয়। ওই চাবিতে লেখা ছিল, ‘আশ্রয়ণের অধিকার, শেখ হাসিনার উপহার’। ফ্ল্যাটের যাঁরা মালিক হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগ জেলে, শুঁটকিশ্রমিক, রিকশা ও ভ্যানচালক, ভিক্ষুকসহ নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ।

এখন পাঁচতলা আরও ৬০টি ভবন প্রস্তুত করা হচ্ছে। আগামী অক্টোবর মাসের শেষ নাগাদ ভবনগুলোর কাজ শেষ হলে কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কুতুবদিয়াপাড়া ও সমিতিপাড়ার আরও আড়াই হাজার পরিবারের অন্তত ৮ হাজার অতিদরিদ্র মানুষের ঠাঁই হবে। ঝুপড়ি থেকে ফ্ল্যাটের মালিক হতে যাওয়া মানুষের আনন্দ যেন শেষ হচ্ছে না।  

দ্বিতীয় ধাপে ফ্ল্যাট পাচ্ছেন দক্ষিণ কুতুবদিয়াপাড়ার বৃদ্ধা হাসিনা বেগম। গতকাল বুধবার দুপুরে জেলা শহরের দক্ষিণ কুতুবদিয়া পাড়ায় গিয়ে কথা হয় হাসিনার সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাসজমিতে তৈরি ঝুপড়ি ঘরে দেড় যুগ ধরে পড়ে আছি। সঙ্গে তিন মেয়ে ও এক ছেলে। উপকূলের শুঁটকিমহালে কাজ করে চলে  সংসার। এখন বিনা মূল্যে ফ্ল্যাটবাড়ি পাব, এই আনন্দে ঘুম আসছে না।’ হাসিনা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তিনি (শেখ হাসিনা) ঝুপড়ি ঘর থেকে আমাদের বিনা মূল্যে ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকার সুযোগ করে দিচ্ছেন। আল্লাহ তাঁকে দীর্ঘজীবী করুন।’

হাসিনা বেগমের বাড়ি ছিল সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের খুদিয়ারটেক গ্রামে। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর বসতভিটা সমুদ্রে বিলীন হয়। তখন জ্বলোচ্ছ্বাসে ভেসে মারা গেছেন স্বামী সৈয়দ আলমসহ পরিবারের তিন সদস্য। এরপর মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে তিনি কুতুবদিয়া থেকে চলে আসেন কক্সবাজার শহরে।

ফ্ল্যাটবাড়ির মালিক হচ্ছেন সমিতিপাড়ার মোহাম্মদ ইসহাক (৫২), মধ্যম কুতুবদিয়াপাড়ার নাজের আহমদ (৭৩), লিয়াকত আলী (৩৯), নুরুল ইসলাম (৮২), পশ্চিম কুতুবদিয়া পাড়ার নুরুল আমিন (৬০), বশির আহমদসহ (৬৬) আরও অনেকে। সবার বাড়ি কুতুবদিয়ায়।

কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকতার কামাল বলেন, তাঁর এই ওয়ার্ডে ১৪ হাজার পরিবারের অন্তত ৪০ হাজার মানুষের বসবাস। ৮০ শতাংশ মানুষ শ্রমজীবী-জলবায়ু উদ্বাস্তু। খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পের জন্য ৪ হাজার ৪০৯ পরিবারের তালিকা করা হলেও অবশিষ্ট ১০ হাজার পরিবারের আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার।

২২ সেপ্টেম্বর আশ্রয়ণ প্রকল্প পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। এ সময় প্রকল্পের অগ্রগতি তুলে ধরেন সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল  আফজাল হোসেন।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমান, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল, বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল আহমেদ, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান প্রমুখ।

মুখ্য সচিব তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া বলেন, পৃথিবীর কোথাও জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য ১৩৭টি পাঁচতলা ভবনের এত বড় আশ্রয়ণ প্রকল্প নেই। বিনা মূল্যে একেকটি ফ্ল্যাটের মালিক হচ্ছেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এবং ঘূর্ণিঝড় ও দুযোগে ক্ষতিগ্রস্ত কক্সবাজার উপকূলের দরিদ্র মানুষ। কক্সবাজারের মানুষের প্রতি শেখ হাসিনার দরদ আছে বলেই খুরুশকুলের এই বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। দ্বিতীয় ধাপে নির্মিত ৬০টি ভবনে মাথা গোঁজার ঠাঁই হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারের।

জেলা প্রশাসন ও পৌরসভা সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নত করতে রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়। রানওয়েসহ অন্যান্য অবকাঠামো তৈরির জন্য অধিগ্রহণ করতে হয়েছে বিমানবন্দরের পশ্চিম পাশ লাগোয়া পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কুতুবদিয়াপাড়া, নাজিরারটেক উপকূলের বিপুল পরিমাণ সরকারি খাসজমি। যেখানে দু-তিন যুগের বেশি সময় ধরে বসতি করছে কয়েক হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবার।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারে এসে জনসভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, মাথা গোঁজার বিকল্প ঠাঁই না করে সরকারি খাসজমি থেকে কাউকে উচ্ছেদ করা হবে না। এরপর খাসজমিতে বসবাসকারী ৪ হাজার ৪০৯ পরিবারের অন্তত ২০ হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তুকে পুনর্বাসনের জন্য খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পে ১৩৭টি পাঁচতলা ভবন ছাড়াও ১০ তলার আরেকটি দৃষ্টিনন্দন শেখ হাসিনা টাওয়ার নির্মাণ করা হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, ২০-২৫ লাখ টাকা দামের প্রতিটি ফ্ল্যাটের মালিক হতে একেকটি পরিবারের খরচ হবে মাত্র ১ হাজার ১ টাকা। এ টাকায় ফ্ল্যাটের মালিকানার দলিল সম্পাদন করা হবে। এত অল্প টাকায় ফ্ল্যাটের মালিক হওয়ার নজির বিশ্বের কোথাও নেই।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিক, বিনোদনের পার্ক, শুঁটকিপল্লি গড়ে তোলা হচ্ছে। এ ছাড়া এ আশ্রয়ণ প্রকল্পে যাতায়াতের জন্য শহরের কস্তুরাঘাটে বাঁকখালী নদীর ওপর তৈরি হচ্ছে ৫৯৫ মিটারের একটি সেতু ও সংযোগ সড়ক।