পূর্ণিমার জোয়ারে বিলীন হচ্ছে শতকোটি টাকার ‘বালুর বাঁধ’

জোয়ারের ধাক্কায় বিলীন হচ্ছে বেড়িবাঁধ। শনিবার দুপুরে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার বিন্দাপাড়া এলাকায়
ছবি: সংগৃহীত

কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়ার চারদিকে জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর বেড়িবাঁধ রয়েছে প্রায় ৪০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১৩০ কোটি টাকা ব্যয় করে ১৮ কিলোমিটারের ভাঙা বাঁধ পুনর্নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। কিন্তু এখন পূর্ণিমার জোয়ারে বিলীন হচ্ছে নতুন করে তৈরি বেড়িবাঁধটি।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, গত তিন দিনের জোয়ারের ধাক্কায় প্রায় আট কিলোমিটারে শতাধিক অংশে বাঁধ ভেঙে গেছে। কয়েকটি অংশে পুরোপুরি বিলীন হয়ে লোকালয়ে সমুদ্রের লোনা পানি ঢুকে পড়ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষের খেতের ফসল ও ঘরবাড়ি। জরুরি ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কার না করলে আরও কয়েক কিলোমিটার বাঁধ সাগরে বিলীন হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কুতুবদিয়া উপজেলা কক্সবাজারের আওতাধীন হলেও সেখানকার বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বান্দরবান জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীকে। কর্মস্থল থেকে শত কিলোমিটার দূরের কুতুবদিয়ায় গিয়ে কাজ তদারকি সম্ভব হয় না নির্বাহী প্রকৌশলীর। অভিযোগ আছে, এই সুযোগে কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ নেন ঠিকাদারের লোকজন।

কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার বিকেল পর্যন্ত তিন দিনের পূর্ণিমার জোয়ারে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের অন্তত আট কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধগুলো কয়েক মাস আগে তৈরি হয়েছে। নতুন বাঁধ জোয়ারের পানিতে বিলীন হওয়ায় স্থানীয় লোকজনের মনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।

ফরিদুল ইসলাম বলেন, আসন্ন বর্ষা মৌসুমে সাগরের জোয়ারের উচ্চতা বাড়লে কিংবা ঝড়-জলোচ্ছ্বাস দেখা দিলে বেড়িবাঁধ টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। ভাঙা বেড়িবাঁধ দ্রুত সময়ে সংস্কারের জন্য তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কুতুবদিয়া বেড়িবাঁধ তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বান্দরবান পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীকে। মানুষ চায় কুতুবদিয়ার বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আগের মতো কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলীর ওপর থাকুক।

বিলীন হচ্ছে ‘বালুর বাঁধ’

শনিবার সকালের জোয়ারে উপজেলার কৈয়ারবিল ইউনিয়নের বিন্দাপাড়া, পরান সিকদার পাড়া, উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের চর ধুরুং, মিয়ারাকাটা, বড়ঘোপ ইউনিয়নে অমজাখালী, সাইট পাড়া, উত্তর বড়ঘোপ, আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নে বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা, পশ্চিম তাবালরচর, দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়নের বাতিঘর এলাকাসহ প্রায় আট কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বিভিন্ন অংশ ভেঙে গেছে। কয়েকটি ভাঙা অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে ঘরবাড়িসহ নিম্নাঞ্চলের ফসলি জমি প্লাবিত হচ্ছে।

জোয়ারের সময় ভাঙছে বাঁধ
ছবি: সংগৃহীত

কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওরঙ্গজেব মাতবর বলেন, উপজেলার চারদিকে পাউবোর ৭১ পোল্ডারের আওতাধীন ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৮ কিলোমিটার ভাঙা বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের বিপরীতে পাউবো ব্যয় করে প্রায় ১৩০ কোটি টাকা। কিন্তু নির্মাণকাজে ব্যাপক অনিয়ম–দুর্নীতি হওয়ায় এখন সামান্য জোয়ারের ধাক্কায় সেই বেড়িবাঁধ ভেঙে যাচ্ছে।

আওরঙ্গজেব মাতবর বলেন, বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে মাটির পরিবর্তে স্থানীয় বালু দিয়ে। অনিয়মের বিষয়টি পাউবো কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার মেলেনি।

কৈয়ারবিল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আজমগীর মাতবর বলেন, মাত্র তিন মাস আগে মাটির সঙ্গে বালু মিশিয়ে এই বেড়িবাঁধ তৈরি করা হয়। বর্ষা শুরুর আগে জরুরি ভিত্তিতে ভাঙা বাঁধ সংস্কার না করলে ইউনিয়নের পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি সমুদ্রে হারিয়ে যাবে। নষ্ট হবে কয়েক একরের ফসলি জমি।

বালু মিশিয়ে বাঁধ নির্মাণের অভিযোগ করেন উত্তর ধুরুং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল হালিম ও স্থানীয় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি আকবর খানও। বিন্দাপাড়ার লবণচাষি সুজা উদ্দিন ও আবু তালেব বলেন, জোয়ারের পানিতেই ডুবে গেছে তাঁদের ২৫ বিঘা জমি। ঘরবাড়ি বিলীন হওয়ার শঙ্কায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন অনেকে।

বাঁধের বিষয়ে কথা বলতে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় পাউবোর বান্দরবান কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী অরূপ চক্রবর্তীর সঙ্গে। তবে তিনি কল ধরেননি।

পাউবো কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী তানভীর সাঈদ বলেন, তিনি এ বিষয়ে কথা বলবেন না। তিনি এ বিষয়ে পাউবোর বান্দরবানের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

কুতুবদিয়ার বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলীকে না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তানভীর সাঈদ বলেন, ‘কিছুদিনের মধ্যে কুতুবদিয়ার বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পুনরায় কক্সবাজারে আসছে।’