ঢোল বানিয়েই খগেন্দ্র কাটিয়ে দিচ্ছেন একটা জীবন
ঢোল বানিয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দিলেন খগেন্দ্র ঋষি (৭৫)। সেই কবে ঢোলের তাল তাঁকে কাছে টেনেছিল, তার থেকে আর দূরে সরা হয়নি। এরই মধ্যে চারপাশে অনেক বদল হয়েছে। মানুষ-প্রকৃতি, হাটবাজার—কত কিছু বদলেছে। তাঁর সেই ঢোল বাঁধনের একলা জীবন নিঃশব্দ-নীরবে চলছে। সঙ্গে অভাব-অনটন, টানাপোড়েন সব সময় ছিল, এখনো তা–ই আছে। তবু ঢোল তাঁকে ছেড়ে যায়নি, তিনিও ঢোলকে ছাড়তে পারেননি।
খগেন্দ্রর সঙ্গে দেখা মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আমতৈল ইউনিয়নের একটি প্রাচীন গ্রামীণ হাট দীঘিরপার বাজারে। সেদিন ছিল সাপ্তাহিক হাটবার, মঙ্গলবার। হাটভর্তি মানুষ, কোলাহল।
হাটের বেশ কিছু গলির একটি দিয়ে ঢুকে দেখা গেল, দক্ষিণ পাশের সারি ধরা দোকানের একটিতে বিভিন্ন আকার ও রঙের অনেকগুলো ঢোল ওপর-নিচ করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তার এক পাশে বসে সুতা দিয়ে ঢোল বাঁধাইয়ের কাজ করছিলেন খগেন্দ্র। তখন এক-দুজন জুতা নিয়ে আসছেন, ফাঁকে ফাঁকে তাঁদের জুতার কাজ করে দিচ্ছেন তিনি। হাটের আর কোনো দিকে তাঁর কোনো কৌতূহল আছে বলে মনে হয় না। কথা বলেও মনে হয়নি, ঢোল বাঁধা আর জুতার কাজের বাইরে অন্য কিছু নিয়ে তিনি তেমন একটা ভাবেন, অন্য কিছু তাঁকে ভাবায়।
দীঘিরপার বাজার থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরের জেলা শহর মৌলভীবাজারে খগেন্দ্রর জন্ম। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থাকিই (থেকে) ঢোল বান্ধার (বাঁধার) কাজ করি। বাপ-দাদার কাছ থাকি ঢোলর কাজ শিখছি।’ সেই যে শিখলেন, ওই শেখার আনন্দই তাঁর নেশা হয়ে গেছে, জীবিকার উপায় হয়েছে। স্বাধীনতার পর জন্ম—শহর ছেড়ে তিনি দীঘিরপার বাজারে চলে আসেন। ওখানেই থিতু হন, ওখানেই দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর ঢোলের সংসার, জীবনের সংসার।
খগেন্দ্রর সংসারে স্ত্রী ও পাঁচ কন্যা। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। দুই মেয়ের বিয়ের বাকি। দোকানের সঙ্গেই তাঁর ঘর। সকালে শুরু হয় কাজ। চলে অনেক রাত পর্যন্ত। আগের ব্যবসা-বাণিজ্য নেই, তবু এখনো ঢোল বাঁধেন। মাঝেমধ্যে জুতা সেলাই করেন। এ দুটোর আয় দিয়েই সংসারের যাবতীয় চাহিদা পূরণ করেন। জানালেন, হবিগঞ্জের একটি কুমারপাড়া থেকে মাটির তৈরি ঢোলের খোল কিনে আনেন তিনি। আকার ও গুণগত মান অনুযায়ী একেকটির দাম পড়ে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। তারপর সুতার কাজ, রং লাগানোসহ অন্য সব আনুষঙ্গিক কাজ তিনি নিজেই করেন। কথা বলার সময়ও তিনি হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন না, সুতা বাঁধার কাজ করছিলেন। ঢোল বাঁধার কাজ করছিলেন। একেকটি ঢোল বিক্রি করেন সাধারণভাবে ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা। কিছু ঢোল চার–পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। এখন ঢোল নিয়মিত খুব একটা বিক্রি হয় না। যাঁরা কীর্তন গেয়ে থাকেন, তাঁদের অনেকে তাঁর কাছ থেকে ঢোল কিনে নিয়ে যান। আর দুর্গাপূজার সময় ২০ থেকে ২৫টি ঢোল বিক্রি হয়ে থাকে।
খগেন্দ্র ঋষি বলেন, ‘৫০ বছর ধরে ঢোল বানাই। সব কাজ একাই করি। কিন্তু এখন ব্যবসায় ডিমান্ড নাই, উন্নতি নাই। এগুলো বিকে (বিক্রি হয়) কম। আগে বেশি বিকতো (বিক্রি হতো)। এখন মেশিনারি জিনিস বাইর অইছে (বেরিয়েছে), চাহিদা নাই।’
রাত তখন অনেকটা বেড়ে গেছে। হাটবার বলেই হয়তো তখনো মানুষের ভিড়ের কমতি নেই। মানুষ নিজেদের লক্ষ্যের দিকে ছুটছে। মানুষের এই ছুটে চলার দিকে তাঁর তেমন একটা চোখ নেই। তিনি দোকানের একটুকরা বারান্দার যে পৃথিবী, সেখানে স্থির হয়ে আছেন। নিজের কাজটুকুতেই সুখ খুঁজছেন। মাঝেমধ্যে হাটের দিকে কিছু অন্ধকার, কিছু আলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। এভাবেই একজন খগেন্দ্র ঋষির দীর্ঘ একটা জীবন ঢোলের সঙ্গেই পার হয়ে যাচ্ছে।