বরিশালে বড় ১২৯টি গাছ কাটতে চায় পাউবো

বরিশালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কলোনির পুরোনো ১২৯টি গাছ কাটতে নিলামে বিক্রি করেছে কর্তৃপক্ষ। এ জন্য গাছগুলোয় নম্বর দেওয়া হয়েছেছবি: সাইয়ান

বরিশাল নগরের বান্দরোডে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কলোনির বিভিন্ন প্রজাতির ১২৯টি গাছ নিলামে বিক্রি করে কেটে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে পাউবো কর্তৃপক্ষ। ৫০ থেকে ৮০ বছর বয়সী এতগুলো গাছ কেন একসঙ্গে কেটে ফেলা হবে, এর পেছনে যৌক্তিক কোনো ব্যাখ্যা নেই পাউবোর কাছে। এরই মধ্যে নিলাম সম্পন্ন করে গাছগুলো কাটার জন্য লাল রং দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে।

পাউবোর এমন সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বরিশালের পরিবেশবাদী সংগঠন ও সচেতন ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, এমনিতেই বরিশাল নগরকে উন্নয়নের নামে ক্রমেই বৃক্ষশূন্য করে ফেলা হয়েছে। এখন নতুন করে পুরোনো এতগুলো গাছ কাটার উদ্যোগ আত্মঘাতী। এতে শহরের পরিবেশ-প্রতিবেশে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল নগরের কীর্তনখোলা নদীর পাড় ঘেঁষে চাঁদমারি, সাগরদি এলাকায় বিশাল আয়তনজুড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যালয় এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা গড়ে ওঠে। স্বাধীনতার আগে এসব স্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষরোপণ করা হয়। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৪ সালে বরিশাল অঞ্চলে সেচব্যবস্থা সম্প্রসারণে পাউবো ‘বরিশাল সেচ প্রকল্প’ (বিআইপি) নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। সেই অনুসারে বর্তমানে কলোনিটি ‘বিআইপি কলোনি’ নামে পরিচিতি পায়।

বিশাল আয়তনের এই কলোনিতে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা নানা প্রজাতির গাছ। এর মধ্যে আছে রেইনট্রি, মেহগনি, শিশুসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। হঠাৎ এমন ১২৯টি গাছ নিলামে দিয়ে কেটে ফেলার এমন সিদ্ধান্তে কলোনির বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু পাউবোর কর্মচারী হওয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এমন পরিবেশঘাতী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে পারছেন না তাঁরা। একই সঙ্গে নগরের পরিবেশবাদী সংগঠন ও সচেতন ব্যক্তিরাও পাউবোর এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়ক লিংকন বায়েন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গাছ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তাই চাইলেও গাছ কাটা যাবে না। সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া গাছ কাটা হলে সেটা অবশ্যই আইন পরিপন্থী। উন্নয়নের জন্য হলেও পরিবেশের বিষয়টি মাথায় রেখে প্রকল্প হাতে নিতে হবে। বিষয়টি দুঃখজনক। আমরা সামাজিকভাবে এ ব্যাপারে আন্দোলন গড়ে তুলব। পাশাপাশি কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে অবশ্যই আমরা আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’

পরিবেশবাদী সংগঠন ও সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, পুরোনো এতগুলো গাছ কাটার উদ্যোগ আত্মঘাতী। এতে শহরের পরিবেশ-প্রতিবেশে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে
ছবি: সাইয়ান

পাউবোর একটি সূত্র জানায়, সাগরদি ও চাঁদমারি পাশাপাশি দুটি কলোনির ১২৯টি গাছ নিলামের জন্য গত ২২ জুন দরপত্র আহ্বান করা হয়। জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে দরপত্র সম্পন্ন হয়। এতে ৪০টির ওপর দরপত্র বিক্রি করা হলেও নিলামে অংশগ্রহণ করেছে মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান। সর্বোচ্চ দর উঠেছে ২৪ লাখ টাকা। সর্বোচ্চ দরদাতা হয়েছেন মো. আরিফ নামের এক ব্যক্তি।

নিলাম বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এবং ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কাটা বা অপসারণে নিলাম দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। নিলামে দুটি ধাপে ১২৯টি গাছ বিক্রি করা হবে। তবে নিলাম দরপত্রে এমনটা দাবি করা হলেও বাস্তব চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। সরেজমিন দেখা গেছে, পাউবোর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়সংলগ্ন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ের পেছনে দুই-তিনটি গাছ বন্যায় ভেঙে গেছে এবং হেলে পড়েছে। তবে নিলামে বিক্রির জন্য রং দিয়ে নম্বর লিখে চিহ্নিত করা হয়েছে সম্পূর্ণ অক্ষত সতেজ গাছগুলোকেও। পরিবেশবাদীদের দাবি, এসব গাছ এখনো সতেজ এবং পুরোপুরি জীবন্ত থাকায় আরও অনেক বছর বাঁচবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআইপি কলোনির কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন কয়েকটি গাছ দেখিয়ে ১২৯টি গাছ বিক্রি করছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে গাছগুলো বিক্রির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি তাঁদের।

জানতে চাইলে পাউবোর বরিশাল জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেসব গাছ নিলামে বিক্রি করা হচ্ছে, সেগুলো ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত। বড় ঝড় হলে এগুলো ভেঙে পড়ে, হেলে পড়ে আমাদের ভবনগুলোকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। তাই নিলামে বিক্রি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা বন বিভাগের অনুমতি নিয়েছি। বন বিভাগ আমাদের শর্ত দিয়েছে, একটি গাছ কাটলে দুটি লাগাতে হবে। আমরা সেই শর্ত মেনেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছি।’

হঠাৎ বিপুলসংখ্যক পুরোনো গাছ কেটে উজাড় করার সিদ্ধান্তকে অন্যায় ও আত্মঘাতী বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী রফিকুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত শুক্রবার আমরা ওই এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি। গাছগুলো এখনো সতেজ ও জীবন্ত। আমরা এসব গাছ যাতে কাটা না হয়, সে জন্য পাউবোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলব। এতগুলো বড় গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী।’