চালকের আসনে শিশু-কিশোর

জুলাই মাসে অন্তত ১৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে এই পরিবহনের মিনিবাসে। প্রাণ গেছে ১০ জনের।

তাকওয়া পরিবহনের চালকের আসনে এক কিশোর। তার নেই বাস চালানোর সনদ। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

রুট পারমিট বা সড়কে চলাচলের অনুমতি আছে ২৫০টি মিনিবাসের, কিন্তু চলছে পাঁচ শতাধিক। অধিকাংশ মিনিবাসের ফিটনেস নেই। চালক ও চালকের সহযোগীদের বেশির ভাগই শিশু-কিশোর। তাদের চালকের আসনে বসার সনদও নেই। এ চিত্র গাজীপুরের তাকওয়া পরিবহনের মিনিবাসের।

গাজীপুরে দুটি মহাসড়কসহ ছয়টি পথে চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ, ফিটনেসবিহীন তাকওয়া পরিবহনের মিনিবাস। জেলা, মহানগর ও হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত জুলাই মাসে অন্তত ১৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে এই পরিবহনের মিনিবাসে। এসবে প্রাণ গেছে ১০ জনের। আহত হয়েছেন অনেকে।

তাকওয়া পরিবহনের চালকের আসনে এক কিশোর। তার নেই বাস চালানোর সনদ। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

চালকদের বেশির ভাগ শিশু-কিশোর হওয়ায় এসব মিনিবাস ঘন ঘন দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় লোকজন। গাজীপুর আদালতের আইনজীবী রফিকুল ইসলাম বলেন, শিশুশ্রম আইন ২০১৩-তে ১৮ বছরের নিচের সবার জন্য গাড়ির চালকের সহকারীর কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সহকারীর কাজই যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ, সেখানে শিশু-কিশোরদের চালক হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। এসব শিশু-কিশোরকে যাঁরা কাজে লাগান, তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্যের অভিযোগও আছে তাকওয়া পরিবহনের মিনিবাসের বিরুদ্ধে। প্রায়ই বাগ্‌বিতণ্ডা ও মারামারির ঘটনা ঘটে। গত ৮ জুলাই নগরীর শিববাড়ী এলাকায় বাসভাড়া নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডার একপর্যায়ে চালকের সহকারী চলন্ত বাস থেকে এক যাত্রীকে ফেলে দিলে তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার চালকের সহকারী হিরা মিয়া আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।

আমি অনেক বড় মানুষের চাইতে ভালো গাড়ি চালাই। বিশ্বাস না হইলে আপনে বইসা দেখেন।
এক কিশোর চালক, তাকওয়া পরিবহন

এই পরিবহনের মিনিবাসে একাধিকবার ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে। এসবে পরিবহনটির কর্মীদেরই জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। সবশেষ ৪ জুলাই ভোররাতে গাজীপুরের ভোগড়া থেকে তাকওয়া পরিবহনে মাওনা যাচ্ছিলেন এক দম্পতি। শ্রীপুর উপজেলার মাস্টারবাড়ী এলাকায় পৌঁছে স্বামীকে মারধর করে চলন্ত বাস থেকে ফেলে দিয়ে স্ত্রীকে পাঁচজন ধর্ষণ করেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সবাই তাকওয়া পরিবহনের কর্মী। তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং সবাই আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন গাজীপুরের পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ।

এর আগে ২০২০ সালে বাসে চকলেট বিক্রেতা এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে তাকওয়া পরিবহনের চালক ও সহকারীদের বিরুদ্ধে। তাঁরাও ওই সময় গ্রেপ্তার হন। মামলাটি চলমান বলে জানিয়েছে পুলিশ।

সম্প্রতি দুই দিন গাজীপুরের চন্দ্রা ত্রিমোড়, কোনাবাড়ী, চান্দনা চৌরাস্তা ও শিববাড়ী—এই চার বাসস্ট্যান্ডে দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে দেখা যায়, কয়েক মিনিট পরপর তাকওয়া মিনিবাস আসা-যাওয়া করছে। এসব মিনিবাসের বেশির ভাগ চালকই কিশোর বয়সী।

গাজীপুর শহর থেকে কালিয়াকৈর সড়কে মিনিবাস চালায় ১৭ বছর বয়সী এক কিশোর। কোনাবাড়ী থেকে চন্দ্রা যাওয়ার পথে কথা হয় তার সঙ্গে। কীভাবে চালকের আসনে বসল জানতে চাইলে এই কিশোর বলে, ‘তিন-চার বছর হেলপারি করছি। এরপর এক বছর কন্ডাক্টর (ভাড়া আদায়কারী) ছিলাম। ওই সময় ওস্তাদ একটু একটু করে গাড়ি চালাইতে দিত। এভাবেই গাড়ি চালানো শিখছি।’

বিআরটিএর গাজীপুর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলাটির বিভিন্ন পথে চলাচলকারী অনেকগুলো মিনিবাসের চালক অদক্ষ কিশোর। সহযোগীরা প্রায় সবাই শিশু বয়সী। তাদের কারণে প্রায় দুর্ঘটনা ঘটছে।

বিআরটিএ সূত্রে আরও জানা যায়, গাজীপুরে ছয়টি সড়কে তাকওয়া পরিবহনের ২৫০টি মিনিবাসের রুট পারমিট রয়েছে। কিন্তু তার চেয়ে দুই গুণ বেশি মিনিবাস চলাচল করছে সড়কগুলোতে।

তাকওয়া পরিবহনের একক কোনো মালিকানা নেই। এর দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন সুলতান সরকার। তিনি গাজীপুর জেলা বাস-মিনিবাস সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি। তাঁর দাবি, আগে হয়তো শিশু-কিশোর চালক বা চালকের সহকারী ছিল, কিন্তু এখন নেই। অনভিজ্ঞ কাউকে নেওয়া হয় না। আর বর্তমানে যেসব গাড়ি চলছে, এর সব কটিরই ফিটনেস ও রুট পারমিট রয়েছে।

চান্দনা চৌরাস্তা থেকে মাওনা পর্যন্ত তাকওয়া মিনিবাস চালাতে দেখা যায় ১৬ বছরের এক কিশোরকে। দেড় বছর বাসে চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করে সাত থেকে আট মাস হলো চালক হয়েছে সে। গাড়ি ভালোভাবে চালাতে পারে কি না, জানতে চাইলে সে বলে, ‘আমি অনেক বড় মানুষের চাইতে ভালো গাড়ি চালাই। বিশ্বাস না হইলে আপনে বইসা দেখেন।’