ইজারার পাটকলে উৎপাদনে ভাটা 

দেশ স্বাধীনের আগে থেকে খুলনায় একের পর এক গড়ে ওঠে শিল্পকারখানা। আশির দশকেও এসব কারখানা ঘিরে ছিল হাজারো মানুষের ব্যস্ততা। একে একে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মসংস্থান হারিয়েছেন মানুষ। ভাটা পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। শিল্পাঞ্চলের বর্তমান অবস্থা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে শেষ পর্ব।

ইজারা দেওয়ার পর কিছু তাঁত চললেও জৌলুশ হারিয়েছে খুলনার দৌলতপুর জুট মিলস। কারখানার ২৫০টি তাঁতের মধ্যে চালু আছে ৩০টি। সম্প্রতি তোলাছবি: সাদ্দাম হোসেন

সাড়ে চার বছর আগে খুলনা-যশোর অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকল বন্ধ করে দেয় সরকার। তখন তিন মাসের মধ্যে পাটকল আধুনিকায়ন করে ইজারার মাধ্যমে আবার চালুর আশ্বাস দিয়েছিল বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি)। পরে ইজারায় চারটি চালু হলেও বড় পরিসরে উৎপাদনে যায়নি। অন্যগুলো কবে চালু হবে, তা অনিশ্চিত।

বন্ধ পাটকল সরকারি মালিকানায় চালুর দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে খুলনার রাজপথে আন্দোলন করছে নাগরিক ও শ্রমিকদের কয়েকটি সংগঠন। ইজারা দিয়ে পাটকলগুলোয় সুদিন ফেরানো যাবে না বলে মনে করছেন তাঁরা। গবেষক গৌরাঙ্গ নন্দী প্রথম আলোকে বলেন, পাটকল বেসরকারি খাতে দেওয়ার অভিজ্ঞতা ভালো না। বেসরকারি খাতে দিয়ে কারখানা শেষ পর্যন্ত ভালোভাবে চলেছে এমন নজির নেই। ইজারা নেওয়ার পর কর্তৃপক্ষ কারখানা থেকে গাছ কেটেছে, যন্ত্রপাতি বিক্রি করেছে, অন্য পক্ষকে ইজারা দিয়েছে। সেগুলো চালানোর চেষ্টা করেনি। তাঁরা শুধু রাষ্ট্রের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। বিজেএমসির শর্তের কারণেও ব্যবসায়ীদের অনেকে অনাগ্রহী।

চারটি পাটকলে আগে দৈনিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৬ মেট্রিক টন। এখন উৎপাদন হচ্ছে ১৮ মেট্রিক টনের মতো।

বিজেএমসি ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২০ সালের ১ জুলাই লোকসান ও উৎপাদন খরচের কারণ দেখিয়ে খুলনা অঞ্চলের ৯টিসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকল একযোগে বন্ধ করে সরকার। এরপর বিজেএমসি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) বন্ধ পাটকল চালুর পরিকল্পনা করেছিল; কিন্তু ব্যবসায়ীরা পিপিপিতে পাটকল চালাতে রাজি হননি। তাঁরা দীর্ঘমেয়াদি ইজারা চেয়েছিলেন। পরে পাটকল চালুর পথ খুঁজতে ১৩ সদস্যের কারিগরি কমিটি করা হয়। কমিটি স্বল্প সময়ের জন্য পাটকল ইজারা দিতে সুপারিশ করে।

সূত্র জানায়, বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছে মধ্য মেয়াদে ১৫ থেকে ২০ বছরের জন্য পাটকল ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বন্ধ ২৫টি পাটকলের মধ্যে ১৭টি ইজারা দিতে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে প্রথম আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রের শর্ত—ইজারাদার শুধু পাট, পাটজাত পণ্য উৎপাদন করতে পারবেন। মেয়াদ হবে ২০ বছর। কিন্তু কেউ তেমন আগ্রহ না দেখানোয় মেয়াদ বাড়িয়ে ৩০ বছর এবং পাটজাত পণ্যের বাইরে টেক্সটাইল পণ্য উৎপাদনের কথাও উল্লেখ করা হয়।

আরও পড়ুন

বিজেএমসি সূত্রে জানা গেছে, খুলনার ৯টি পাটকলের জমির পরিমাণ ৫১৬ একর। এর মধ্যে ২৮৮ একর ইজারা দেওয়া হয়েছে বা প্রক্রিয়াধীন। চারটি পাটকল বেসরকারি খাতে ভাড়ায় দেওয়া হয়েছে। বন্ধ হওয়ার আগে পাটকলগুলোয় দৈনিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ৫৬ মেট্রিক টন। ইজারা দেওয়ার পর উৎপাদন হচ্ছে দৈনিক ১৮ মেট্রিক টনের মতো।

খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর মধ্যে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে দৌলতপুর জুট মিলটি ফরচুন গ্রুপের কাছে ইজারা দেওয়া হয়। ফরচুন গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউনি ওয়ার্ল্ড ফুটওয়্যার টেকনোলজি কারখানায় স্বল্প পরিসরে উৎপাদন শুরু করে জুতা তৈরির কাজ করছে।

দৌলতপুর জুট মিলে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন শ্রমিক পাটের বস্তা তৈরি করছেন। আরেকটি অংশে জুতা তৈরি হচ্ছে। কারখানায় ৬০০ জনের মতো শ্রমিক কাজ করছেন। এর মধ্যে ১৮০ জন পাটের কাজ ও অন্যরা জুতা উৎপাদনে কাজ করছেন। কারখানায় ২৫০টির মতো তাঁত আছে, এখনো চলছে ৩০টি। বন্ধ হওয়ার আগে সেখানে দৈনিক লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ মেট্রিক টন, এখন উৎপাদন হচ্ছে ১ দশমিক ২৫ মেট্রিক টন।

ফরচুন গ্রুপের আইনি পরামর্শক মো. মাসুম বিল্লাহ কারখানাটির ব্যবস্থাপনায় জড়িত। উৎপাদন কমের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রথমত পাটের অনেক দাম। শ্রমিকেরা বেশির ভাগই খুলনা ছেড়েছেন। তরুণ শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের বেশির ভাগই বয়স্ক। এ ছাড়া কারখানা কমিটি নামের লোকজন মাঝেমধ্যে এসে ঝামেলা করছেন। পুরাটা লোকসান হচ্ছে। এরই মধ্যে সাড়ে চার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। তাঁরা জুতার উপকরণে পাটপণ্য ব্যবহারের উদ্যোগ নিচ্ছেন।

কারখানাটির তিন শ্রমিক বলেন, ‘এখানে পাটের শ্রমিক কম, জুতার শ্রমিক বেশি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বেতন কম। সংসার চলে না।’

গত বছরের নভেম্বরে যশোরের রাজঘাট এলাকার জেজেআই জুট মিলের ইজারা পায় আকিজ গ্রুপ। কারখানা সূত্র বলছে, এখন সেখানে এক পালায় ছয় মেট্রিক টনের মতো পাটপণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। কারখানাটি আধুনিক করতে তারা বিনিয়োগ করেছে। প্রতিদিন ১৫০ মেট্রিক টন পাটপণ্য উৎপাদন করতে চায়। আগে চারটা তাঁত চালাতে ছয়জনের মতো লাগত। নতুন মেশিনে একজন শ্রমিক চারটা তাঁত চালাতে পারবেন।

জেজেআই জুট মিলের প্রকল্প প্রধান আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, পুরোনো মেশিন দিয়ে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন পাওয়া যাচ্ছে না। শর্তের মধ্যে থেকে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে তাঁরা নতুন মেশিন বসাচ্ছেন। এরই মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি নতুন মেশিন বসানো হয়েছে। তাঁরা পণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর জোর দিচ্ছেন।

আরও পড়ুন

ইস্টার্ন ও কার্পেটিং মিল দুটি ভারতের রিগ্যাল গ্রুপকে ইজারা দেওয়া হয়েছে। বন্ধ হওয়ার আগে দুটি মিলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৩ মেট্রিক টনের বেশি। এখন সেখানে ১০ মেট্রিক টনের মতো উৎপাদন হচ্ছে। খুলনা অঞ্চলের বাকি পাটকলের মধ্যে খালিশপুর জুট মিল ইজারা নিতে শর্তানুযায়ী অগ্রিমের টাকা জমা দিয়েছে রেডিয়েন্ট গ্রুপ; কিন্তু এখনো হস্তান্তর হয়নি। ক্রিসেন্ট জুট মিল ইজারা নিতে ‘ঢাকা শকস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখিয়েছিল। তারা কিছুটা সময় চেয়েছে। আলিম জুট মিলের মালিকানা নিয়ে মামলা চলায় কোনো সিদ্ধান্ত নেই। খুলনার স্টার ও প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিল ইজারা দিতে আগ্রহীদের থেকে আন্তর্জাতিক আবেদন আহ্বান করেছে বিজেএমসি।

বিজেএমসির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পাটপণ্যের শতভাগ কাঁচামাল ছিল দেশের। সস্তা শ্রমিক, সমৃদ্ধ ওয়ার্কশপ ছিল। তাই লোকসানের অজুহাতে মিল বন্ধ হওয়ার কথা ছিল না। অভাব ছিল সুষ্ঠু পরিকল্পনার। অন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান লাভ করছে। তাহলে তাদের পদ্ধতি রাষ্ট্রীয় মালিকানার কারখানায় প্রয়োগ করলে তো সমস্যা থাকে না।

পাটকল রক্ষায় সম্মিলিত নাগরিক পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মুনীর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করা হয়েছে লুটপাটের জন্য। ইজারায় চালু হলেও লাভে যাবে না, শ্রমিকেরাও সম্মানজনক বেতন পাবেন না। সর্বশেষ বন্ধ ২৬টি পাটকল ও সংশ্লিষ্ট স্থাপনার কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ কীভাবে দেশি-বিদেশি গোষ্ঠী লুটপাট করবে তারই আয়োজন চলছে। এ আয়োজনের নিষ্ঠুর বলি সাধারণ ও অসহায় শ্রমিকেরা।