১৯১৪ সালের কথা। ভারতের আসনসোলের চায়ের দোকান থেকে দারোগা রফিজউল্লাহ কিশোর নজরুলকে নিজের বাড়িতে এনেছিলেন। ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার কাজীর শিমলা গ্রামে অবস্থিত রফিজউল্লাহ দারোগার বাড়ি ছিল ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম আবাস। পরে তাঁর ঠাঁই হয়েছিল ত্রিশালের নামাপাড়া গ্রামে বিচুতিয়া ব্যাপারী নামের একজনের বাড়িতে। দুই বাড়ি মিলিয়ে কবি ত্রিশালে ছিলেন আনুমানিক এক বছর।
কাজী নজরুল ইসলামের এক বছরের কথা দারুণভাবে মনে রেখেছে ত্রিশাল। এক শতাব্দীর বেশি সময় পরও ত্রিশাল যেন এখনো কবির আবাসস্থল। কবির বসবাসের দুটি বাড়িতেই করা হয়েছে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র। নজরুল ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে নির্মিত হয় ওই দুটি কেন্দ্র। দুটি কেন্দ্রই পরিচালনা করছে নজরুল ইনস্টিটিউট।
গত মঙ্গলবার সকাল ১০টায় শিমলা গ্রামের দারোগা বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্মৃতিকেন্দ্রটি সুনসান। তখনো কোনো দর্শনার্থী ছিলেন না। দ্বিতল ভবনটির নিচতলায় প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে কবির ব্যবহৃত কাঠের তৈরি খাটটি। একই তলায় রয়েছে একটি ছোট মিলনায়তন। আর ওপরের তলায় একটি পাঠাগারে রয়েছে বেশি কিছু বই। ভবনের দেয়ালে কাজী নজরুল ইসলাম ও তাঁর পরবর্তী কয়েক প্রজন্মের সদস্যের ছবি ঝোলানো হয়েছে। নজরুলের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে এ দারোগা বাড়িতে। সেটার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন স্মৃতিকেন্দ্রের গ্রন্থাগারিক রাসেল হোসেন।
নামাপড়া গ্রামে বিচুতিয়া ব্যাপারীর বাড়ির স্মৃতিকেন্দ্রে দুপুর পৌনে ১২টায় গিয়ে দেখা যায়, হাতে গোনা কয়েকজন দর্শনার্থী। তিনতলার এ স্মৃতিকেন্দ্রের নিচতলায় রয়েছে মিলনায়তন। দোতলায় চলে দাপ্তরিক কাজ। তৃতীয় তলাটি হচ্ছে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র ও গ্রন্থাগার। এ স্মৃতিকেন্দ্রে নজরুলের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রাখা আছে একটি গ্রামোফোন। এ ছাড়া কক্ষের দেয়ালজুড়ে আছে কবি নজরুলের ছবি। কবির হাতের লেখা কবিতা বাঁধাই করে ছবির পাশাপাশি দেয়ালে সাঁটানো।
বিচুতিয়া ব্যাপারী বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, স্মৃতিকেন্দ্রটির পাশাপাশি এর চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ মানুষকে আকৃষ্ট করার মতো। তিনতলা ভবনটির চারপাশে গাছ। সামনে শানবাঁধানো পুকুরঘাট। আশপাশের মানুষ এখানে বেড়াতে আসেন। ব্যাপারী বাড়িতে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রের মূল ভবনের পাশেই কবির থাকার ঘরটি। মূল ভিত্তি ঠিক রেখে নতুন করে করা হয়েছে টিনের একটি বাড়ি।
ব্যাপারী বাড়িতে কবি নজরুলের আশ্রয়দাতা ছিলেন বিচুতিয়া ব্যাপারী নামের একজন ব্যবসায়ী। নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রের সামনে দেখা হয় বিচুতিয়া ব্যাপারীর বংশধর মো. আবুল কাশেমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর নজরুলের জন্মদিনে এখানে অনুষ্ঠান হয়। অনেক মানুষ আসেন। গুণীজনেরা আসেন। এটা আমাদের জন্য খুব আনন্দের বিষয়। আমরা দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকি।’
বিচুতিয়া ব্যাপারী বাড়ি স্মৃতিকেন্দ্রটি নামাপাড়া গ্রামে। এ গ্রামেই রয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিনই সেখানে যান। তবে কাজীর শিমলার দারোগা বাড়ি স্মৃতিকেন্দ্রে দর্শনার্থীর সংখ্যা কম। সেখানে প্রতিদিন হাতে গোনা কয়েকজন দর্শনার্থী যান। শুক্র, শনিবার ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য দুটি স্মৃতিকেন্দ্র খোলা থাকে।
স্মৃতিকেন্দ্র দুটির সহকারী পরিচালক আক্তারুজ্জামান মণ্ডল জানান, দুটি স্মৃতিকেন্দ্রেই শিশুদের জন্য নজরুলসংগীত প্রশিক্ষণ চালু রয়েছে। দারোগা বাড়ি কেন্দ্রে রয়েছে ২৫ জন শিক্ষার্থী। ব্যাপারী বাড়িতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০। সপ্তাহে দুদিন করে চলে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। ভবিষ্যতে আবৃত্তি ও নাচের প্রশিক্ষণ চালু করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, কবির জন্মজয়ন্তীতে দারোগা ও ব্যাপারী বাড়ি স্মৃতিকেন্দ্রে প্রতিবছর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা হয়।