কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য-শিক্ষক ‘দ্বন্দ্বে’ অস্বস্তি

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রথম আলোর ফাইল ছবি

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এফ এম আবদুল মঈনের সঙ্গে শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব এখন চরমে। প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, স্বেচ্ছাচারিতা, পদোন্নতিতে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনসহ নানা অভিযোগ এনে উপাচার্যের বিরুদ্ধে এককাট্টা শিক্ষকেরা। আর নিজেদের প্রধান কাজ গবেষণা ও উন্নত জার্নালের জন্য প্রকাশনা না করায় শিক্ষকদের প্রতি ক্ষুব্ধ উপাচার্য।  

এমন পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন চার শিক্ষক। উপাচার্যের দপ্তরে তাঁর পক্ষ নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়িয়েছেন দুই কর্মকর্তা। এ ঘটনার কোনো সুরাহা না হওয়ায় ক্ষুব্ধ শিক্ষকেরা। সব মিলিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম আবদুল মঈন। যোগদানের পর থেকে তাঁর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক পদে জ্যেষ্ঠদের পাশ কাটিয়ে কনিষ্ঠ শিক্ষকদের দায়িত্ব দেওয়া, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া, পছন্দের শিক্ষকদের পদোন্নতি দিয়ে অন্যদের আটকে দেওয়ার অভিযোগ উঠতে থাকে একের পর এক। এমন বিভিন্ন ঘটনায় ক্ষুব্ধ শিক্ষকেরা এবার উপাচার্যের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছেন।

কনিষ্ঠদের দিয়ে ‘হয়রানি’

যোগদানের পর থেকে উপাচার্য এ এফ এম আবদুল মঈন কনিষ্ঠদের দিয়ে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের হয়রানি করছেন বলে অভিযোগ শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. আবু তাহেরের। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত আট শিক্ষক দাবি করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু জ্যেষ্ঠ শিক্ষক রেখে প্রক্টর, প্রাধ্যক্ষসহ বিভিন্ন পদে কনিষ্ঠ শিক্ষকদের দায়িত্ব দিয়েছেন উপাচার্য। তাদের নিজের আজ্ঞাবহ রাখতে উপাচার্য জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করেছেন। এই কনিষ্ঠ শিক্ষকেরা জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের সঙ্গে অসদাচরণ করলেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয় না।

এ বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ‘যাঁকে দিয়ে কাজ হবে, তাঁদের প্রশাসনিক দায়িত্ব দিয়েছি। এখানে কে জ্যেষ্ঠ, কে কনিষ্ঠ, সেটা দেখছি না।’

হেনস্তার ‘বিচার’ নেই

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নীল দলের শিক্ষকদের কোন্দলের জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছর ধরে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন হচ্ছিল না। এতে শিক্ষকদের পদোন্নতি আটকানোসহ নানা ঘটনা ঘটে। পরে বিবদমান পক্ষ ও সাধারণ শিক্ষকেরা একজোট হয়ে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি শিক্ষক সমিতির নির্বাচন করেন। জয়ী নেতারা ওই দিন বিকেলে উপাচার্যের দপ্তরে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে যান। দাবিদাওয়া ও নানা অনিয়মের কথা নিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে তাদের উচ্চবাচ্য হয়। তখন কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ জাকির হোসেন, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের চুক্তিভিত্তিক পরিচালক দেলোয়ার হোসেন ও শাখা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ইমরান হোসাইনসহ একদল নেতা-কর্মী সেখানে ঢুকে শিক্ষকদের গালাগাল ও লাঞ্ছিত করেন বলে শিক্ষকদের অভিযোগ।

যোগদানের পর থেকে উপাচার্য এ এফ এম আবদুল মঈন কনিষ্ঠদের দিয়ে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের হয়রানি করছেন।
অধ্যাপক মো. আবু তাহের, শিক্ষক সমিতির সভাপতি

এ ঘটনায় গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জাকির হোসেনসহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. আবু তাহের। দুই দিন পর শিক্ষকদের বিরুদ্ধে পাল্টা জিডি হয়।

অভিযোগের বিষয়ে উপাচার্য এ এফ এম আবদুল মঈন বলেন, ‘এ ঘটনা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পাইনি। পেলে ব্যবস্থা নেব।’

বিভাগের দায়িত্বে ‘অনিয়ম’

২০২৩ সালের আগস্টে গণিত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক খলিফা মোহাম্মদ হেলালের দায়িত্ব শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে প্রশাসন থেকে তাঁকে দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ার চিঠি দেওয়া হয়। শিক্ষকদের দাবি, সাধারণত মেয়াদ শেষের দুই-তিন দিন আগে এমন চিঠি আসে। তিনি এক মাস বাড়তি দায়িত্ব পালন করেন। পরে শিক্ষকেরা বসে সভা করে তাঁকে আইন–বহির্ভূতভাবে দায়িত্ব পালন না করার অনুরোধ করেন। পরে গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি দায়িত্ব থেকে সরে যান।

যাঁকে দিয়ে কাজ হবে, তাঁদের প্রশাসনিক দায়িত্ব দিয়েছি। এখানে কে জ্যেষ্ঠ, কে কনিষ্ঠ, সেটা দেখছি না।
এ এফ এম আবদুল মঈন, উপাচার্য

একাধিক শিক্ষকের ভাষ্য, নিয়ম অনুযায়ী তিন বছর পরপর জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে বিভাগীয় প্রধান পরিবর্তন হওয়ার কথা। তবে কয়েকটি বিভাগে এই নিয়মের লঙ্ঘন হয়েছে। ইংরেজি বিভাগের পরবর্তী বিভাগীয় প্রধান হওয়ার কথা অধ্যাপক এম এম শরীফুল করীমের; কিন্তু দায়িত্বে আছেন বনানী বিশ্বাস। বাংলা বিভাগের প্রধান হওয়ার কথা অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম মাওলার, দায়িত্ব পালন করছেন মুহাম্মদ শামসুজ্জামান মিলকী। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হওয়ার কথা অধ্যাপক মো. আবু তাহেরের; কিন্তু দায়িত্বে আছেন সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ জুলহাস মিয়া।

এ বিষয়ে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এম এম শরীফুল করীম বলেন, ‘জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন ও নিয়ম না মেনে উপাচার্য এসব কাজ করছেন। এসব কারণে শিক্ষকেরা তাঁর ওপর বিরক্ত।’

পদোন্নতি নিয়ে ‘অনিয়ম’

গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোসা. শাহীনুর বেগম, কাজী ওমর সিদ্দিকী ও মো. সাহেদুর রহমানের চাকরির মেয়াদ ১১ বছর পূর্ণ হয়। তাঁরা সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির আবেদন করেন। গত ১৭ জানুয়ারি পদোন্নতি বোর্ড গঠন করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী ১১ বছর চাকরি ও জার্নালে তিনটি প্রকাশনা থাকলে পদোন্নতি পাওয়ার কথা। শাহীনুর বেগম ছাড়া বাকি দুজন পদোন্নতি পান।

শাহীনুর বেগম বলেন, ‘আমার সব শর্ত পূরণ হয়েছে। তবুও আমাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি।’ এ বিষয়ে উপাচার্যের দাবি, ‘শাহীনুরের ডিগ্রি ছিল না। শর্ত পূরণ হয়নি। তাই পদোন্নতি দেয়নি বোর্ড। এটা বোর্ডের সিদ্ধান্ত। আমি বোর্ডের সভাপতি মাত্র।’
তবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আইনুল হকের দাবি, পদোন্নতির ক্ষেত্রে ডিগ্রির কোনো বিষয় নেই। পছন্দের শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠ করতে উপাচার্য এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এ ছাড়া ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নকীবুন নবী ও ফিরোজ আহমেদ এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সিমু দের পদোন্নতি আটকে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে উপাচার্যের বিরুদ্ধে। এ ঘটনার পর মূলত শিক্ষকেরা এককাট্টা হয়ে প্রতিবাদ শুরু করেন।

পদ ছাড়েন ৪ শিক্ষক

উপাচার্যের দপ্তরে শিক্ষকদের হেনস্তার ঘটনায় গত ২০ ফেব্রুয়ারি সহকারী প্রক্টরের পদ থেকে সরে দাঁড়ান ফার্মেসি বিভাগের প্রভাষক মো. কামরুল হাসান। শেখ হাসিনা হলের প্রাধ্যক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা ও অশিক্ষকসুলভ আচরণের প্রতিবাদে একই দিন হাউস টিউটরের পদ ছাড়েন পরিসংখ্যান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কুলছুম আক্তার। এর আগে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষকদের প্রতি অন্যায্য আচরণের প্রতিবাদে সহকারী প্রক্টরের পদ ছাড়েন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুল হাসান। এ ছাড়া অব্যবস্থাপনার অভিযোগে গত ৭ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষের পদ ছাড়েন হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক তোফায়েল হোসেন মজুমদার।

আরও পড়ুন

তোফায়েল হোসেন মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘উপাচার্য দুই বছর পর চলে যাবেন। এখানে আমরা পুরো কর্মজীবন থাকব। তখন সহকর্মীদের সঙ্গে চলতে হবে। অন্যায়ের দায়ভার এড়াতে পদত্যাগ করেছি।’

যা বলছেন উপাচার্য

উপাচার্য এ এফ এম আবদুল মঈন মনে করেন, তিনি স্বচ্ছতার সঙ্গে নিয়ম মেনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছেন। শিক্ষকদের ক্লাসে উপস্থিতি নিশ্চিত করা ও গবেষণায় মন দিতে বলায় শিক্ষকেরা তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আবদুল মঈনের ভাষায়, ‘শিক্ষকদের প্রধান কাজ গবেষণা করা ও প্রকাশনা বের করা। কিন্তু এই শিক্ষকেরা প্রকাশনা করতে চান না, গবেষণা করতে চান না। উন্নত মানের জার্নালে তাঁদের প্রকাশনা নেই। এগুলো নিয়ে কথা বলায় আমার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনেছেন তাঁরা। এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। যাঁরা এত দিন দুর্নীতি করলেন, তাঁরাই আমাকে দুর্নীতিবাজ বলছেন।’

তবে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. আবু তাহের উপাচার্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, ‘চাইলেই কেউ যখন-তখন গবেষণা করে জার্নালে প্রকাশ করতে পারেন না। এ জন্য সময় লাগে। শিক্ষকেরা ক্লাস নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। প্রশ্ন তৈরি, খাতা দেখা, মূল্যায়নসহ বিভিন্ন কমিটির দায়িত্ব পালন করেন তাঁরা। উপাচার্য শিক্ষকদের বিপক্ষে কাজ করছেন।’