লোনা জমিতে সবজির রাজ্য

খেত থেকে সবজি তুলছেন কয়েকজন শ্রমিক। সম্প্রতি বরগুনার তালতলী উপজেলার সওদাগরপাড়া এলাকায়ছবি: মোহাম্মদ রফিক

লবণাক্ততার কারণে এক যুগ আগে যে জমিতে ধানের চাষও করা যেত না, সেখানেই এখন বছরজুড়ে রকমারি ফসল ফলাচ্ছেন চাষিরা। তাঁদের চেষ্টায় বরগুনার তালতলী উপজেলার সওদাগরপাড়া গ্রামের লোনা জমি হয়ে উঠেছে উর্বরভূমি। পুরো এলাকা পরিণত হয়েছে সবজির রাজ্যে।

শাহাদাত হোসেন নামের এক কৃষকের হাত ধরে উপকূলের কৃষিতে এই পরিবর্তন এসেছে। লবণাক্ত জমির জন্য তিনি বিশেষ এক চাষপদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন, স্থানীয়ভাবে যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘কান্দি’। কৃষিবিদেরা বলছেন, এই চাষপদ্ধতিকে বৈজ্ঞানিকভাবে রেইজড বেড
(জমি উঁচু করার) পদ্ধতি বলা হয়।

সওদাগরপাড়া গ্রামের দুই দিকে নদী, এক দিকে সাগর। নদী থেকে গ্রামে ঢোকা খালগুলোয় লবণাক্ত পানির প্রবাহ। সেই পানি মাটিতে মিশে যায়। লবণাক্ততার কারণে বছরের বেশির ভাগ সময় গ্রামের ৪ হাজার ৯৪০ একর জমি অনাবাদি থাকত। বছরে শুধু আমন ধান ফলাতেন কৃষকেরা। সওদাগরপাড়া আদর্শ কৃষি সমিতির হিসাবে, শেষ দুই মৌসুমে (এক বছরে) গ্রামে প্রায় ৯০ হাজার মণ সবজির উৎপাদন হয়েছে, বিক্রি হয়েছে কয়েক কোটি টাকায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরগুনার উপপরিচালক জোবাইদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এ অঞ্চলের লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে কৃষিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সে ক্ষেত্রে সওদাগর পাড়ার কৃষকেরা নিজেদের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে যেভাবে ফসল ফলাচ্ছেন, তা সারা দেশের কৃষকদের অনুকরণীয় হতে পারে।

শুরু হলো যেভাবে

কৃষক শাহাদাত হোসেন সওদাগর পাড়ার পতিত জমিতে ফসল চাষের উপায় খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি নিচু জমির চারপাশের মাটি কেটে মাঝখানে উঁচু করে সবজির আবাদ করলেন। 

তবে সেচের জন্য মিঠাপানি নিয়ে চিন্তায় পড়লেন। একপর্যায়ে সেটিরও সমাধান বের করলেন। শাহাদাত জানান, খেতের পাশের জমি থেকে মাটি কেটে নেওয়ায় প্রায় ছয় ফুট গভীর গর্ত হয়। এতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা যায়। এই পানি শুষ্ক মৌসুমে সেচ দেওয়া যায়। মাঘের শেষ সময়ে খেতের পাশের কুয়ায় জমিয়ে রাখা বৃষ্টির পানি দিয়ে বোরো আবাদও হচ্ছে। আগে গ্রামে বোরো আবাদ হতো না। 

শাহাদাতের পদ্ধতি অনুসরণ করে সফলতা পেয়েছেন কৃষক মিজান পঞ্চায়েত। তিনি জানান, শীতের শেষ দিকে বৃষ্টির জমানো পানি বোরো আবাদের জন্য সেচ দেওয়ার পর শেষ হয়। এরপর পায়রার শাখা তালতলী খাল থেকে পাইপের সাহায্যে পানি এনে সেচ দিতে হয়। এ জন্য বিএডিসি তাঁদের দুটি পাম্প মেশিন ও পাইপ দিয়েছে।

শাহাদাত হোসেন বলেন, সবজি চাষের জন্য জমি তৈরির সময় ওপরের অংশের মাটি নিচে এবং নিচের মাটি ওপরে চলে আসে। এতেই লবণাক্ততার প্রভাব কমানো সম্ভব হয়েছে। তাঁরা যে বেড তৈরি করছেন, তা সমতল থেকে সাড়ে তিন ফুট উঁচু। ফলে সেখানে লবণাক্ততা ছড়াতে পারে না। 

উপজেলা ভারপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা মো. রাসেল বলেন, বছরব্যাপী সবজির আবাদের সূত্র ধরেই গত দুই বছর গ্রামের ৪০০ হেক্টরে জমিতে বোরো আবাদও হচ্ছে।

ছড়িয়ে পড়ছে ‘কান্দিপদ্ধতি’

সওদাগরপাড়ায় ২০১২ সালে প্রথম কান্দিপদ্ধতিতে সবজির আবাদ শুরু করেন শাহাদাত হোসেন। তাঁর দেখাদেখি গ্রামে এখন ২৪০ জন কৃষক ৪৯৪ একর জমিতে সবজি আবাদ করছেন। গঠন করেছেন সওদাগরপাড়া আদর্শ কৃষি সমিতি। মূলত শীত মৌসুমে শিম, মরিচ, বেগুন আর বর্ষা মৌসুমে মরিচ, শসা, মিষ্টিকুমড়া, তরমুজ চিচিঙ্গা, ঝিঙে, বরবটি ও লাউ বেশি আবাদ হয়। 

সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, চারদিকে গাঢ় সবুজ সবজি খেত। কয়েক শ নারী-পুরুষ কাজ করছেন খেতে। কৃষক টুটুল মিয়া ও মাসুম বিল্লাহ জানান, কান্দিপদ্ধিতে সবজি উৎপাদনে গ্রামে বিপ্লব ঘটে গেছে।

সওদাগরপাড়ার দেখাদেখি পটুয়াখালীর কলাপাড়ার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের কুমিরমারা গ্রামের কৃষকেরাও কান্দিপদ্ধতিতে ফসল আবাদ শুরু করেন। ২০১৮ সালে তাঁরা নীলগঞ্জ আদর্শ কৃষক সমিতি গঠন করেন। যার বর্তমান সদস্য ১৬২ জন। সমিতির সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, তাঁদের সমিতির উদ্যোগে গোটা ইউনিয়নে প্রায় আট হাজার কৃষক কান্দিপদ্ধতিতে চাষ করছেন। যে জমিতে ফসল হতো না, সেই জমিকে কৃষকেরা বহুফসলি জমিতে রূপান্তর করেছেন।

শাহাদাত হোসেন

গ্রামে ফিরছেন বাসিন্দারা

কৃষিতে সাফল্য আসায় এখন আর গ্রামের বাসিন্দাদের বিকল্প কাজের কথা ভাবতে হয় না। কৃষকেরা জানান, কাজের সন্ধানে শহরে যাওয়া গ্রামের অনেকে এসে কৃষির হাল ধরেছেন। অনেক শিক্ষিত তরুণও কৃষিতে যুক্ত হচ্ছেন।

অভাবের কারণে ১০ বছর আগে চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন সওদাগরপাড়া গ্রামের সামসুল হক। ২০২১ সালে তিনি ফিরে আসেন। অন্যের কিছু জমি এক বছরের জন্য ইজারা নিয়ে আবাদ শুরু করেন। লাভের মুখ দেখায় এখন তিনি ৩ একর ৬৬ শতাংশ জমিতে সবজির আবাদ করেন। সামসুল হক বলেন, প্রতিবছর সবজি আবাদ করে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা আয় হচ্ছে।

পটুয়াখালী সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. বায়েজিদ। লেখাপড়ার পাশাপাশি আড়াই বিঘা জমিতে সবজি চাষ করেছেন তিনি। বায়েজিদ বললেন, ‘সবার দেখাদেখি আমার বাবাও সবজি চাষ শুরু করেন। করোনার কিছু আগে বাবা মারা যাওয়ার পর আমি সংসারের হাল ধরি। এখন বছরে চার লাখ টাকা আয় হয়। আমার মতো আরও ২০ শিক্ষার্থী সবজি আবাদ করছেন।’

স্বাবলম্বী গ্রামের নারীরা

গ্রামের বাসিন্দা ফিরোজা বেগমের (৫৫) চার সদস্যের পরিবার। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তাঁর দিনমজুর স্বামী। কিন্তু তিনি আট বছর ধরে শয্যাশায়ী। পাঁচ মাস ধরে সবজি খামারে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন ফিরোজা। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন দুই বেলা খাবারসহ ৩০০ টাকা পাই। এই টাকা দিয়ে স্বামীর ওষুধ কেনা ও সংসারে খরচ জোগাতে পারছি।’

কৃষকদের এই উদ্যোগ জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ও ঝুঁকি হ্রাসের অসাধারণ দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূলবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান হাফিজ আশরাফুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন আমাদের উচিত তাঁদের এই কৌশলগুলো অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া।’