বিরোধের পুকুর এখন মুখর পাখির কলরবে

দিনাজপুরের বিরামপুর পৌরসভার চকপাড়া মহল্লার বিরোধপূর্ণ পুকুরে গত ৫ বছর ধরে আসে অতিথি পাখিছবি: প্রথম আলো

দূর থেকে মনে হবে, পুকুরে মরা কচুরিপানার শুকনা পাতার সমারোহ। কাছে গেলে দৃশ্যপট একেবারেই ভিন্ন। দেখা মেলে ঝাঁক ঝাঁক বালিহাঁসের। কেউ পাখায় ঝাপটা দিচ্ছে। কেউ সবুজ কচুরিপানার ফাঁক দিয়ে নিচে পানিতে ঠোঁট ডুবাচ্ছে। কেউ কেউ দল বেঁধে উড়ে অদূরে পুকুরের আরেক জায়গায় বসছে। আবার কেউ দল বেঁধে বসে কলরব করছে।

এমন দৃশ্যের দেখা মিলবে দিনাজপুরের বিরামপুর পৌরসভার চকপাড়া মহল্লার একটি বিরোধপূর্ণ পুকুরে। পুকুরটির আয়তন প্রায় ৭ বিঘা। পুকুরটির চারপাশে পাড় ঘেঁষে জনবসতি। পুকুরের মাঝের অংশটি দেখতে সমতল দ্বীপের মতো। আর এর চারপাশ ঘিরে বলয়াকৃতির প্রায় ১০ মিটার চড়া ক্যানেল। পুকুরজুড়ে কচুরিপানা। আর এসব কচুরিপানার ওপর বসে আছে হাজারো বালিহাঁস। বালিহাঁসের এমন বৈচিত্র্যময় দৃশ্য দেখতে শহর ও শহরের বাইরে থেকে আসেন দর্শনার্থীরা।

পারিবারিক বিরোধের জেরে প্রায় ছয় বছর ধরে পুকুরটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। পাঁচ বছর আগে একদিন হঠাৎ প্রায় ২৫০ বালিহাঁসের একটি ঝাঁক উড়ে এসে পুকুরের মাঝখানে বসে। তখন আশপাশের কৌতূহলী মানুষ বালিহাঁস দেখার জন্য ভিড় জমিয়েছিলেন। আগের মতো সেই ভিড় এখন আর নেই। তবে প্রায় দিনই বিরামপুর ও আশপাশের এলাকা থেকে প্রকৃতিপ্রেমীরা এখানে পাখি দেখতে আসেন। সঙ্গে শিশুদের নিয়ে আসেন অনেকে। এসব তথ্য জানালেন চকপাড়া মহল্লার স্থায়ী বাসিন্দা মকরেবুল ইসলাম।

শুক্রবার বিকেলে বিরামপুর পৌরশহরের পূর্ব জগন্নাথপুর মহল্লা থেকে ছয় বছরের নাতি নাফিজ ইসলামকে পাখি দেখতে নিয়ে এসেছেন লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, ‘শুক্করবার ছুটির দিনোত হামার নাতি বায়না ধরিছে, তাক (তাকে) ঘুরবার তনে বাইরোত নিবার যাবার হবে। পাড়ার একজনার কাছোত শুননো, চকপাড়াত নাকি একটা বড় পুকুরোত বিদেশ থেকে অনেকগুলা পাখি আইছে। তাই বিকালবেলা মোটরসাইকোলোত চড়ে নাতিক নিয়ে পাখি দেখপার নিয়ে আইছু। গাঁয়ের মাঝখানোত একসাথে এত্তগুলা পাখি দেখে নাতি তো হামার খুব খুশি।’

স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব বালিহাঁস পুকুরটিতে ইচ্ছেমতো থাকে। কখনো কখনো কিছুক্ষণের জন্য উড়ে কোথাও চলে গেলেও দিন শেষে আবার পুকুরেই ফিরে আসে। এসব বালিহাঁসকে এলাকার কেউ বিরক্ত করে না। অচেনা কোনো দর্শনার্থী পুকুরপাড়ে এসে বালিহাঁসগুলোকে বিরক্ত করার চেষ্টা করলে পুকুরপাড়ে বাসিন্দারা এসব করতে তাঁদের নিষেধ করেন।

এ বিষয়ে বিরামপুর পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুকুরটি নিয়ে শরিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। পুকুরটি নিয়ে মামলাও চলছে। এ কারণে এটি প্রায় ছয় বছর ধরে পরিত্যক্ত। দ্বন্দ্বের কারণে সেখানে এখন কেউ মাছের চাষও করেন না। পুকুরটিতে জনসাধারণের আনাগোনা না থাকায় এটি এখন অতিথি পাখিদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। পাখিগুলো আমাদের এলাকার মেহমান। তাদের যাতে কেউ ক্ষতি করতে না পারে, সে জন্য এলাকার মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করি।’

বিরামপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বিপুল কুমার চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবছর শীতের সময় সুদূর সাইবেরিয়া থেকে এসব অতিথি পাখি বাংলাদেশে আসে। আবার মার্চ-এপ্রিলের দিকে পাখিগুলো তাদের নিজ আবাসস্থলে ফিরে যাবে। এসব অতিথি পাখিকে আশ্রয় দেওয়া ও রক্ষা করা আমাদের প্রত্যেক সচেতন মানুষের দায়িত্ব। বাংলাদেশে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে পাখিকে বিরক্ত বা হত্যা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসব অতিথি পাখির যাতে কেউ কোনো ক্ষতি না করে, সে জন্য ওই এলাকায় উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের যেসব কর্মী কাজ করেন, তাঁদের মাধ্যমে এলাকার জনসাধারণকে সচেতন করা হবে।’