নোনাজমিতে ভরসার বাগান, কয়রার নারীদের উদ্ভাবনী চাষাবাদ

খুলনার কয়রা উপজেলার রত্নাঘেরী গ্রামের বিউটি বেগম উঠানে তৈরি উঁচু কাঠামোর বাগান থেকে তাজা বরবটি তুলছেন। ১২ নভেম্বর কয়রা উপজেলার রত্নাঘেরী গ্রামে তোলাছবি: প্রথম আলো

সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রার নোনাজল আর ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশের মধ্যেও স্থানীয় নারীরা বদলে দিয়েছেন নিজেদের বাড়ির চেহারা, বদলে দিয়েছেন কৃষির ধরন। কোথাও বারান্দায় ঝুলছে বস্তাভরা সবজি, কোথাও উঠানে উঁচু টাওয়ার গার্ডেন, কেউবা পুকুরের ওপর ভাসমান কাঠামোয় গড়ে তুলেছেন ছোট ছোট সবুজ বাগান।

ঘরের সামনে ঝুলে থাকা দুটি প্লাস্টিকের বস্তায় বাড়তি নজর পড়ে কয়রা গ্রামের জেসমিন নাহারের বাড়িতে গেলে। ভেতরে জৈব সার-মেশানো মাটিতে গজিয়েছে পুঁইশাক। দূর থেকে সাজানো কোনো শোপিস মনে হলেও কাছে গেলে স্পষ্ট হয়—এটি একটুকরা জীবন্ত বাগান। বাড়ির পাশেও বাঁশ ও চটা দিয়ে উঁচু কাঠামো বানিয়ে জেসমিন সাজিয়েছেন আরও অনেক বস্তা—কোথাও বেগুন, কোথাও আদা, কোথাও মিষ্টিকুমড়া ও লাউ।

সম্প্রতি জেসমিনের বাড়িতে গেলে তিনি বলেন, ‘বর্ষার সময় বাড়ির চারপাশে পানি জইমে যায়, শুকনোর সময় আবার মাটিতে লবণ ওঠে। তাই বস্তায় জৈব সার মাটি দিয়ে উঁচু করি সবজি লাগাইছি। এখন নিজেরা খাচ্ছি, কিছু বিক্রিও করিছি।’

পাশের বাড়ির মরিয়ম বেগমও উঠানে বস্তায় মরিচ, ঢ্যাঁড়স ও লাউ লাগিয়েছেন। মাচার পাশে ঝুলছে এক জোড়া পুরোনো জুতা। হাসতে হাসতে মরিয়ম বলেন, ‘দুষ্টু মানুষের নজর লাগে গাছে, তাই জুতা ঝুলাই দিছি। আগে নিচু জমিতে কিছুই হতো না, এখন ফলন ভালো হয়।’

ঘরের বারান্দার ছাউনির নিচে ঝুলছে দুটি বস্তাভর্তি সবুজ গাছ। এভাবে নারীরা জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় নিজেদের মতো করে টিকিয়ে রেখেছেন কৃষির স্বপ্ন। কয়রা উপজেলার কৃষাণি জেসমিন নাহারের বাড়ি থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

উত্তর বেদকাশীর শারমিন সুলতানা ও শ্রাবণী বিশ্বাসও জানান, ছোট জায়গায় জলবায়ুসহিষ্ণু বাগান করে তাঁরা এখন স্বাবলম্বী। পরিবারের পুষ্টির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আশপাশের মানুষের চাহিদা পূরণ করতে কিছু সবজি বিক্রি করেন তাঁরা।

স্থানীয় নারীদের চাষাবাদের বড় উদাহরণ কয়রার বড়বাড়ি গ্রামের বীণা রায়। বেসরকারি সংস্থার দেওয়া প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে উঠানের এক কোণে বাঁশ, জাল ও বাতা দিয়ে চার-পাঁচ ফুট উঁচু গোল টাওয়ার বানিয়ে সেখানে লাগিয়েছেন লাউ। মাচাজুড়ে ঝুলছে লাউ। তিনি বলেন, ‘টাওয়ার–পদ্ধতিতে ফলন ভালো হয়। বর্ষায় পানি উঠলেও ক্ষতি হয় না। শুকনা মৌসুমে লবণাক্ততা বাড়লেও টাওয়ারের মাটি আলাদা থাকে। এখন পর্যন্ত ৪৬টা লাউ বিক্রি করেছি।’

বীণার স্বামী সুশান্ত রায়ও এখন চাষের সঙ্গী। তিনি বলেন, ‘শুধু উঠানে নয়, ঘরের পেছনে বাঁশের কাঠামোয় বস্তা সাজিয়ে সবজি লাগিয়েছি, পুকুরের মধ্যে খুঁটি পুঁতে সঙ্গে নেটের ঝুড়ি ঝুলিয়ে ডালি পদ্ধতিতেও চাষ করেছি। এখন মানুষ আমাদের বাড়িতে দেখতে আসে, ছবি তোলে, আমাদের ভালো লাগে।’

কয়রার জেসমিন নাহারের ঘরের পাশে বস্তায় চাষ করা হয়েছে বেগুন, আদা ও পুঁইশাক। জলবায়ুসহিষ্ণু এই পদ্ধতিতে সারা বছরই ফলন পান তিনি। ১১ নভেম্বর কয়রা গ্রাম থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

বুধবার সকালে কয়রার শাকবাড়িয়া নদীর তীরের রত্নাঘেরী গ্রামে গেলেও একই চিত্র দেখা যায়। নদীর ওপারে সুন্দরবন; আর এপারে নদীর ধারে এনামুল হক আর আনোয়ারা বেগমের উঠানজুড়ে সারি সারি বস্তা আর একটি বড় টাওয়ারে শসা, তরমুজ, লাউ, মরিচ, বেগুন—সব মিলিয়ে ১৩ রকমের গাছ।

আনোয়ারা বলেন, ‘আগে ভাবতাম এই নিচু লবণাক্ত মাটিতে কিছুই হবে না। এখন নিজেরাই চাষ করছি। ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস এলেও বস্তার গাছগুলো সহজেই উঁচু জায়গায় তুলে রাখা যায়। ফলে গাছ বাঁচে, ফসলও বাঁচে।’

এনামুল বলেন, ‘আমি ভ্যান চালাই, কখনো সুন্দরবনে যাই মাছ-কাঁকড়া ধরতে। আগে সব কিনে খেতে হতো, এখন নিজেরা ফলানো সবজি খেতে পারছি—এটাই বড় পাওয়া।’

পুকুরের পানির ওপর তৈরি কাঠামোয় ‘ডালিপদ্ধতি’র সবজি চাষ কয়রার গৃহবধূদের নতুন উদ্ভাবন। ১১ নভেম্বর কয়রার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের বড়বাড়ি গ্রাম থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

রত্নাঘেরীর বিউটি বেগমের উঠানেও এখন সবুজের ছোঁয়া। উঁচু কাঠামোয় ভরা মাটিতে লাগানো বরবটির গাছে ঝুলছে সারি সারি বরবটি। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘গতকাল এক কেজি তুলেছি, আজ কিছুটা কম আছে। আগে সবজি হতো না, এখন নতুন পদ্ধতিতে চাষ করছি, ফলন ভালো হচ্ছে।’

বেসরকারি সংস্থা সিএনআরএসের গবেষণা সহযোগী মো. শাহ পরান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কৃষির সম্পর্ক গভীর। তাই কয়রার ৫০ জন নারীকে পিচার বা কলসপদ্ধতির সেচ, মালচিং, টাওয়ার ও বস্তায় চাষ, জৈব সার তৈরি ও হাত পরাগায়নে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সহজ ও টেকসই হওয়ায় স্থানীয়রা দ্রুত এসব পদ্ধতি গ্রহণ করছেন।

কয়রা উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আল মাহফুজ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কৃষি উৎপাদন টিকিয়ে রাখার সবচেয়ে কার্যকর উপায়ই হলো জলবায়ুসহিষ্ণু কৃষি। কয়রার মতো ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় এ পদ্ধতি খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতি ও টেকসই জীবনব্যবস্থা গঠনে সহায়তা করছে।