লবণের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে না পরলেও আমদানির প্রয়োজন নেই, আশ্বাস বিসিকের
কক্সবাজারে চলতি মৌসুমে উৎপাদিত লবণ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় সাড়ে তিন লাখ টন কম হলেও মাঠে পড়ে থাকা ১৪ লাখ টন লবণ দিয়েই দেশের চাহিদা মেটানো যাবে বলে জানাচ্ছে বিসিক। তবে চাষিরা দামের ধস, ঋণের চাপে বিপাকে। সিন্ডিকেটের দাপটে লবণের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না তাঁরা। ফলে ক্ষতির মুখে ১০ লাখের বেশি মানুষ।
কক্সবাজারে লবণ উৎপাদনের ছয় মাসের মৌসুম শেষ হয়েছে। উৎপাদন ২২ লাখ ৫১ হাজার মেট্রিক টন। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৬ লাখ ১০ হাজার টন। ফলে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৮ হাজার টনে।
তবু এই ঘাটতি সত্ত্বেও দেশজ চাহিদা পূরণে কোনো সংকট হবে না বলে আশ্বস্ত করেছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। সংস্থাটি জানিয়েছে, মাঠে এখনো অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে প্রায় ১৪ লাখ মেট্রিক টন লবণ।
বিসিক-কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে (গত বছরের ১৫ নভেম্বর থেকে ১৭ মে পর্যন্ত) কক্সবাজার সদর, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, টেকনাফ ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় ৬৮ হাজার ৫০৫ একর জমিতে লবণের চাষ হয়েছে। ১৭ মে পর্যন্ত ওই পরিমাণ জমিতে লবণ উৎপাদিত হয়েছে ২২ লাখ ৫১ হাজার ৬৫১ মেট্রিক টন। লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার পেছনে গত এপ্রিল মাসের শেষে এবং মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে দুই দফার বৃষ্টিকে দায়ী করছেন কৃষকেরা। তবে তাপপ্রবাহের কারণে দৈনিক ২৮ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদনেরও রেকর্ড হয়েছে এবার।
চামড়া ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা উৎপাদনে ঘাটতির কারণে কোরবানির পর পশুর চামড়া সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত লবণ মিলবে না। ঘাটতির কারণে বাড়তে পারে দাম। চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন লবণের প্রয়োজন হয়।
তবে চামড়া ব্যবসায়ীদের এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন বিসিকের কর্মকর্তারা। বিসিক কক্সবাজার লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের উপমহাব্যবস্থাপক জাফর ইকবাল ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, চলতি মৌসুমে সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন লবণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম উৎপাদিত হলেও দেশে সংকট হবে না। কারণ, কক্সবাজারের চাষিদের হাতে অন্তত ১৪ লাখ মেট্রিক টন লবণ অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। চাষিদের হাতে মজুত থাকা লবণ দিয়ে কোরবানির সময় চামড়া সংরক্ষণসহ নভেম্বর পর্যন্ত চাহিদা পূরণ করা যাবে। ফলে বিদেশ থেকে লবণ আমদানির কোনো দরকার নেই।
দেশে বছরে গড়ে ২৬ লাখ টন লবণের চাহিদা থাকে। তার বড় অংশ আসে কক্সবাজার, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, টেকনাফসহ উপকূলীয় অঞ্চলের লবণ চাষ থেকে। চলতি মৌসুমে ৬৮ হাজার ৫০৫ একর জমিতে লবণের চাষ হয়েছে, যা গত বছরের সমপরিমাণ জমির সমান।
গর্তে লবণ সংরক্ষণ
গত শনিবার দুপুরে কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল ইউনিয়নে গিয়ে দেখা গেছে, কয়েক হাজার একর লবণ চাষের জমি থেকে চাষিরা পলিথিন সরিয়ে নিয়েছেন। এর অর্থ, উৎপাদন বন্ধ এই মৌসুমের জন্য। অনেক চাষি উৎপাদিত লবণ মাটির গর্তে সংরক্ষণ করেছেন বলে জানান। কিছু চাষি উৎপাদিত লবণ ঘরের আঙিনায়, সড়ক ও খালের পাশের উঁচু জমিতে স্তূপ করে তার ওপর ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রেখেছেন।
কক্সবাজার লবণচাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মো. মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ৩ হাজারের বেশি মাটির গর্ত ও খোলা মাঠে ১০ লাখ মেট্রিক টনের বেশি লবণ পড়ে আছে। আরও কয়েক লাখ টন চাষিদের ঘরে মজুত আছে। আসন্ন বর্ষা মৌসুমে লবণের দাম না বাড়লে চাষিরা পথে বসবেন। গত বছর প্রতি মণ লবণের দাম ৫০০ টাকা উঠলেও এবার ৩০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়নি। দেশের প্রভাবশালী দালাল সিন্ডিকেট মাঠপর্যায়ে উৎপাদিত লবণের দাম কমিয়ে দিয়ে নিজেরা লাভবান হলেও দেখার কেউ নেই। যে কারণে জেলার ৪৪ হাজার প্রান্তিক চাষি, ১ লাখ শ্রমিকসহ লবণ উৎপাদন, পরিবহন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অন্তত ১০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত।
চামড়া ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা উৎপাদনে ঘাটতির কারণে কোরবানির পর পশুর চামড়া সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত লবণ মিলবে না। ঘাটতির কারণে বাড়তে পারে দাম। তবে এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন বিসিকের কর্মকর্তারা। বিসিক বলছে, চাষিদের হাতে মজুত থাকা লবণ দিয়ে কোরবানির সময় চামড়া সংরক্ষণসহ নভেম্বর পর্যন্ত চাহিদা পূরণ করা যাবে।
দামের ফারাক, সিন্ডিকেটের দাপট
চাষিরা বলছেন, মাঠে লবণের কেজি ৭ টাকায় বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে তা ৩০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝখানে লাভ চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী দালালদের পকেটে। চৌফলদণ্ডীর চাষি নুরুল ইসলাম বলেন, দাম বাড়ে না, বরং সিন্ডিকেট মাঠের দাম চেপে ধরে রাখে। কেউ দেখেও দেখে না।
খুরুশকুলের চাষি নজরুল ইসলাম (৫৫) বলেন, গত বছরের ২১ নভেম্বর তিনি পাঁচ কানি (কানিতে ৪০ শতক) লবণ চাষ করেন। ১৭ মে উৎপাদন শেষ হয়। মাঝখানে এপ্রিল ও মে মাসে দুই দফার বৃষ্টিতে ১৪ দিন লবণ উৎপাদন বন্ধ ছিল। মৌসুমজুড়ে তাপপ্রবাহ বিরাজ করায় ভালো উৎপাদিত হলেও দাম কমে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তিনি। লোকসান দিয়ে এখনো লবণ বিক্রি করতে হচ্ছে। বর্তমানে প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ২৭০ থেকে ২৮০ টাকায়, যা এপ্রিল মাসে ছিল ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা। প্রতি মণ লবণ উৎপাদনের বিপরীতে চাষিদের খরচ হয়েছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা।
তবে বিসিক বলছে, মৌসুমজুড়ে মাঠপর্যায়ে নিবিড় নজরদারি রাখা হয়েছে এবং সরকারি নজরদারি থাকলে মজুত থাকা লবণ থেকেই দেশের প্রয়োজন মেটানো যাবে। ডিসেম্বর থেকে নতুন মৌসুম শুরু হলে উৎপাদনও শুরু হবে।