এক শিক্ষক দিয়ে চলছে জামালপুরের চর উত্তর রুস্তম আলী মাস্টার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ৫ নম্বর চর উত্তর রুস্তম আলী মাস্টার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আছেন মাত্র একজন শিক্ষক। তিন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে পাঠদান করছেন তিনি। গত বুধবার। ছবি: প্রথম আলো

সময় তখন বেলা একটা। বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ একেবারে ফাঁকা। বিদ্যালয়ের চারদিকে সুনসান নীরবতা। শ্রেণিকক্ষগুলোর দরজায় তালা ঝুলছে। তবে একটি শ্রেণিকক্ষ থেকে হালকা লেখাপড়ার শব্দ ভেসে আসছিল।

শ্রেণিকক্ষটিতে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি মিলে মাত্র ১০ জন শিক্ষার্থী। তাদের সবাইকে একসঙ্গে ব্ল্যাকবোর্ডে পড়াচ্ছেন এক শিক্ষক। পুরো বিদ্যালয়ে আছেন মাত্র একজন শিক্ষক। যিনি আবার প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে রয়েছেন।

জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ৫ নং চর উত্তর রুস্তম আলী মাস্টার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র এটি। শিক্ষক না থাকায় বিদ্যালয়টিতে ঠিকমতো ক্লাস হয় না। তাই শিক্ষার্থীরাও স্কুলে আসতে চায় না। শিক্ষক–সংকটের কারণে বিদ্যালয়টিতে প্রতিবছর শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে।

গত বুধবার সরেজমিনে বিদ্যালয়টিতে শিক্ষক–সংকটের এ চিত্র চোখে পড়ে। বিদ্যালয়টিতে রয়েছে একতলার একটি পাকা ভবন। ভবনের শ্রেণিকক্ষগুলো সাজানো–গোছানো। তবে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের শিক্ষকের অভাব। শিক্ষকের পাঁচটি পদের বিপরীতে আছেন একজন। তাঁর নাম শাহ জামাল, যিনি বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক। এক বছর ধরে তিনি একাই ক্লাস নিচ্ছেন ও দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন করছেন।

কথা হয় শাহ জামালের সঙ্গে। তিনি বলেন, ২০১৭ সালে বিদ্যালয়টি সরকারীকরণ হয়। ২০১৮ সাল থেকে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। তখন বিদ্যালয়ে আরও একজন সহকারী শিক্ষক ছিলেন। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ওই সহকারী শিক্ষক বদলি হয়ে চলে যান। এর পর থেকে তিনি একাই বিদ্যালয়টি সামলাচ্ছেন। বিদ্যালয়ে ৬৯ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের মধ্যে প্রাক্‌-প্রাথমিকে ১০ জন, প্রথম শ্রেণিতে ১০, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১২, তৃতীয় শ্রেণিতে ১২, চতুর্থ শ্রেণিতে ১৩ ও পঞ্চম শ্রেণিতে ১২ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।

শাহ জামাল জানান, প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকায় প্রায়ই তাঁকে দাপ্তরিক বিভিন্ন কাজে উপজেলা সদরে যেতে হয়। শিক্ষক না থাকায় অভিভাবকেরা সন্তানদের এ বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে চান না। একসময় এই বিদ্যালয়ে প্রায় ১৫০ জন ছাত্রছাত্রী থাকলেও শিক্ষক-সংকটের কারণে কমতে কমতে এখন ৬৯ জনে ঠেকেছে। অনেক অভিভাবক ছাড়পত্র নিয়ে যাচ্ছেন।

বিদ্যালয়ের এ পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, বিদ্যালয়টি প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের মধ্যে। বিদ্যালয়ে যাতায়াতের যোগাযোগব্যবস্থা ভালো নয়। ফলে এখানে শিক্ষকেরা থাকতে চান না। এক বছর ধরে বিদ্যালয়ে একজনই শিক্ষক। একজন শিক্ষক কীভাবে এতগুলো ক্লাস নেবেন। তারপরও তিনি যেটুকু পারেন, সেটুকু পড়ান। শিক্ষক–সংকটের কারণে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে। তাঁরা দ্রুত সময়ের মধ্যে বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানান।

মো. শরিফ, শরিফুল ইসলাম, শাপলা আক্তারসহ বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, শিক্ষক না থাকায় ঠিকমতো তাদের ক্লাস হয় না। অনেক সময় তারা নিজেরা ক্লাসে বসে থাকে। শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীরা অন্য স্কুলে চলে যাচ্ছে। প্রতিদিন সব মিলিয়ে ১৫ থেকে ২০ জনের বেশি হয় না। তবে শিক্ষক থাকলে শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসবে। নতুন শিক্ষক দেওয়া হলে তাদের লেখাপড়া আরও ভালো হতো বলে জানায় এই শিশুরা।

বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য আনোয়ার হোসেন বলেন, সরকারীকরণ হওয়ার পর থেকেই বিদ্যালয়ে শিক্ষক নেই। এক বছর ধরে প্রধান শিক্ষক একাই আছেন। মূল সমস্যা, বিদ্যালয়ের রাস্তাঘাট ভালো নয়। এখানে শিক্ষকেরা আসতে চান না। দু-একজন এলেও খুব দ্রুত বদলি হয়ে যান।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে মেলান্দহ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘এ উপজেলায় সদ্য যোগদান করেছি। তবে ইতিমধ্যে ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক–সংকটের বিষয়টি জেনেছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষক দেওয়া হবে।’