গরিব পটুয়াখালীতে একের পর এক সমস্যা, সংকট

বাড়ির পাশে সুপেয় পানির উৎস নেই। তাই দূর থেকে পানি আনছেন স্থানীয় নারী-পুরুষেরা। গত ৭ ডিসেম্বর পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর মৌডুবী এলাকায়ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

বরিশাল বিভাগকে বলা হতো ‘বাংলার শস্যভান্ডার’ আর পটুয়াখালী তারই অংশ। জলবায়ু পরিবর্তন ধীরে ধীরে পটুয়াখালীকে দেশের অন্যতম দরিদ্র জেলা বানিয়েছে; কিন্তু এখানেই শেষ নয়। পুরোনো প্রভাবের পাশাপাশি নতুন নতুন সমস্যার মুখে ফেলছে পটুয়াখালীর মানুষকে। ফলে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে জীবন-জীবিকা, ঝরে পড়ছে বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থী, হুমকিতে জনস্বাস্থ্য। নারীরা পড়ছেন যৌনস্বাস্থ্যের জটিল সব সমস্যার মুখে। বাধ্য হয়ে জলবায়ু আর দারিদ্র্যের কাছে মানুষ অসহায় আত্মসমর্পণ করছে অথবা এলাকা ছাড়ছে।

ডিসেম্বরের হিম হিম সকাল। দোচালা টিনের ঘরের বারান্দায় কাঁথা-কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন এক বয়োজ্যেষ্ঠ। চরের সবাই তাঁকে একনামে চেনেন—মতলেব মল্লিক। প্রবীণ মতলেবের চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে শ্রম আর লড়াইয়ের চিহ্ন। একের পর এক ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে লড়াই করা মতলেবের চোখে ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় গোর্কির স্মৃতি এখনো ভয় ধরায়। তিনি বলেন, ‘সে কি ভয়ংকর ঝড়। কোথাও মাটি দ্যাহা যায় না; ঘরবাড়ি দ্যাহা যায় না। চারদিক পানি আর পানি।’

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার এমন গল্প পটুয়াখালীর ঘরে ঘরে আছে। গত ৩ থেকে ৯ ডিসেম্বর জেলার বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে জলবায়ু যুদ্ধের মুখোমুখি হননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে পটুয়াখালী এখন দেশের অন্যতম দরিদ্র জেলায় পরিণত হয়েছে।

গত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চালিতাবুনিয়ায় মতলেব মল্লিকের সঙ্গে কথা হয়। ’৭০–এর ঘূর্ণিঝড়ে নারকেলগাছের আগায় লটকে বেঁচে ছিলেন মতলেব; কিন্তু পরদিন বাড়ি ফিরে দেখেন—মা, স্ত্রী, এক ছেলে ছাড়া আর কিছু নেই। তিনি বলেন, ‘মাইয়াডা নাই, বোনডাও নাই, ঘরবাড়ি উধাও; ১৫ জোড়া গরু–মহিষ, ধানের গোলা কিচ্ছু নাই’—এখনো দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বিশাল জমিতে আমনের সময় ৫০০-৬০০ মণ ধান হতো তাঁদের, সেই জমিজমা সব পানিতে।

দুর্যোগের ধাক্কা থামে না মতলেবের জীবনে। আরও চারবার ঘরবাড়ি ভেঙেছে তাঁর। জমিজমা, সম্পত্তি যা কিছু ছিল, সব ছিনিয়ে নিয়েছে ঝড়, বন্যা আর নদীভাঙন। ঘরের ভিটা পর্যন্ত চলে গিয়েছিল; পরে চালিতাবুনিয়া বাজারের পশ্চিমে একখণ্ড জমি কিনে বাড়ি করে সেখানেই ছেলেদের সংসারে পড়ে আছেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার এমন গল্প পটুয়াখালীর ঘরে ঘরে আছে। গত ৩ থেকে ৯ ডিসেম্বর জেলার বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে জলবায়ু যুদ্ধের মুখোমুখি হননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে পটুয়াখালী এখন দেশের অন্যতম দরিদ্র জেলায় পরিণত হয়েছে।

২০১৯ সালে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (নিপোর্ট) বেসরকারি এক জরিপে দেখা যায়, পটুয়াখালীতে দরিদ্র খানার হার ৬০ দশমিক ৬ শতাংশ। এর পরই রয়েছে কুড়িগ্রাম ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ এর আগের কয়েক বছর কুড়িগ্রামই ছিল দেশের দরিদ্রতম জেলা। নিপোর্ট, আইসিডিডিআরবি এবং মেজার ইভ্যালুয়েশন যৌথভাবে বাংলাদেশের সামাজিক জনমিতি ও স্বাস্থ্যসেবা সূচক নিয়ে ২০১৮ সালে এই জরিপ করে।

অবশ্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সঙ্গে নিপোর্টের জরিপের ব্যবধান অনেক। বিবিএসের বাংলাদেশের দারিদ্র্য মানচিত্র ২০২২ অনুসারে, পটুয়াখালীতে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে নিপোর্টের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সূচকের ভিন্নতার কারণে বিবিএসের সঙ্গে নিপোর্টের জরিপের পার্থক্য হওয়া স্বাভাবিক। বিবিএস মূলত জনশুমারির তথ্য বিশ্লেষণ করে খানা আয়–ব্যয়ের হিসাব বিবেচনায় নিয়ে জরিপ করে থাকে। নিপোর্টের জরিপে জনশুমারির তথ্যের বাইরে পারিবারিক আয় ছাড়াও ঘরের অবস্থা, বিদ্যুৎ-সংযোগ, টয়লেটের ধরন, বাসার ধরন, টেলিভিশন ও মুঠোফোন আছে কি না, এসব বিষয় সূচক হিসেবে নেওয়া হয়।

মতলেব মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, আশপাশের দশ গ্রামে আমার মতো অনেক গেরস্ত ছিল, যাদের গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, গোয়ালভরা গরু-মহিষ ছিল। একের পর এক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রায় সবাই নিঃস্ব হয়েছে। গেরস্তের বংশধরদের অবস্থা হয়েছে আরও খারাপ।

এসব সমস্যার মুখোমুখি হয়ে পটুয়াখালীর মানুষদের স্বাস্থ্যও এখন হুমকির মুখে। একশনএইড বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চলমান এক জরিপে দেখা গেছে, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ৪৫ শতাংশ মানুষ এখন গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় ভুগছেন। চর্মরোগ, ঘন ঘন জ্বর, ঠান্ডা ও সর্দিজনিত অসুখ, ডায়রিয়া, ডায়াবেটিস, ফুসকুড়ির মতো রোগ এখানকার বাসিন্দাদের নিত্যদিনের ঘটনা।

বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ের তথ্যে দেখা গেছে, ১৫৫৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত এ দেশে অন্তত ৭০টি ঘূর্ণিঝড়ের অর্ধেকই সরাসরি আঘাত হেনেছে পটুয়াখালীতে। ২০০৭ সালে সিডরের পর থেকে সর্বশেষ ২০২৪ সাল পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে দেখা যায়, এই দেড় যুগে আঘাতহানা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসগুলোতে পটুয়াখালীর হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, এক লাখের বেশি বাড়িঘর সম্পূর্ণ বা আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে, নষ্ট হয়েছে হাজার কোটি টাকার ফসল ও মাছ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ।

এসব সমস্যার মুখোমুখি হয়ে পটুয়াখালীর মানুষদের স্বাস্থ্যও এখন হুমকির মুখে। একশনএইড বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চলমান এক জরিপে দেখা গেছে, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ৪৫ শতাংশ মানুষ এখন গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় ভুগছেন। চর্মরোগ, ঘন ঘন জ্বর, ঠান্ডা ও সর্দিজনিত অসুখ, ডায়রিয়া, ডায়াবেটিস, ফুসকুড়ির মতো রোগ এখানকার বাসিন্দাদের নিত্যদিনের ঘটনা।

নদীভাঙনে নিঃস্ব

রাঙ্গাবালীর চর মোন্তাজ ইউনিয়নের প্রবেশমুখ থেকে ৫০০ মিটার এগিয়ে হাতের ডানে একটি ছোট মসজিদ, পাশে পুকুর। গত ৭ ডিসেম্বর সকালে পুকুরলাগোয়া ধানখেতে শুয়ে পড়া ধান কাটছিলেন নূরুল হাওলাদার (৬০)। দুই প্রয়াত বন্ধু খালেক হাওলাদার ও রশীদ খাঁর কথা স্মরণ করে নূরুল বললেন, ‘এলাকায় ধনসম্পদে আমরা তিন বন্ধু আগায়া ছিলাম। আমার নিজের ১০ কানি (১৬ একর) জমি দরিয়ায় লইয়া গ্যালো। তাও ভালো, ততদিনে পোলামাইয়াগুলা বড় অইয়া গ্যাছিলো। নাইলে হ্যাগোরে লইয়া পথে বওয়া লাগতো।’

চালিতাবুনিয়া দ্বীপের নজরুল ইসলামের (৪৫) গল্প আরও করুণ। পৈতৃক সূত্রে তাঁদের অন্তত ১০০ কানি (১৬০ একরের বেশি) জমি ছিল, নদীভাঙনে সব জমিই হারিয়েছে তাঁর পরিবার। এখন ১০ শতক জমি কিনে কোনোরকমে ঘর–সংসার টিকিয়ে রেখেছেন নজরুল।

পটুয়াখালীর ভেতরে–বাইরে মোট ৪২টি নদী বয়ে গেছে। এসব নদীর বেশির ভাগই প্রতিনিয়ত চাষাবাদযোগ্য জমিসহ ভিটেমাটি ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে। ২০১৭ সালে জার্নাল অব সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড ইনফরমেশন ইনফরমেটিকস–এ প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, ২০০২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে প্রায় এক হাজার একর চাষাবাদযোগ্য জমি, ২১০টি পরিবার, দুটি বাজার, তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১০টি মসজিদ পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

রাঙ্গাবালীর চর মোন্তাজের তেঁতুলিয়া নদী ঘেঁষে একমাত্র হিন্দুপাড়ায় এখন ১২০টি পরিবারের বাস। ১০–২০ হাত দূরে দূরে করা বাড়ির এই পাড়া আগে ছিল বনজঙ্গল। তাদের আদি পাড়া এখন তেঁতুলিয়া নদীর গর্ভে। এ পাড়ার মানুষের আকুতি— সরকার যেন একটা শক্তপোক্ত বেড়িবাঁধের ব্যবস্থা সেখানে করে, নাহলে এলাকাছাড়া হতে হবে তাঁদের।

মরিচ বা অন্যান্য খেতে যখন পানি দেওয়া লাগে, ওই সময়ে এমন গরম শুরু হয় যে ঘরেই থাকা যায় না। দিনের বেলায় মাঠে পা দেওয়া যায় না। মনে হয়, মাটির মধ্যে আগুন লাইগা রইছে। কাজকাম সব বন্ধ কইরা গাছের ছায়া খোঁজা লাগে, তা–ও যদি নিস্তার পাওয়া যাইতো
কুয়াকাটার চর কাউয়া চরের বাসিন্দা আলাউদ্দিন চৌকিদার

গরমে মাঠে থাকা দায় কৃষকের

পটুয়াখালী জেলা আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য বলছে, গত কয়েক বছরে এ জেলায় গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য হারে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছে। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২২ সালে গড়ে ৮৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। এই দুই সালের শুধু এপ্রিল মাসের বৃষ্টিপাতের পার্থক্য দেখা দিয়েছে ৩৫ মিলিমিটারের বেশি।

আবার আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গ্রীষ্মকালে তাপপ্রবাহ ছিল ১১৫ দিন। গ্রীষ্মের বাকি দিনগুলোর অধিকাংশ সময় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর।

এমন পরিস্থিতিতে গরমকালে কৃষকেরা মাঠে কাজ করতে পারেন না বলে জানান কুয়াকাটার চর কাউয়া চরের বাসিন্দা আলাউদ্দিন চৌকিদার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘মরিচ বা অন্যান্য খেতে যখন পানি দেওয়া লাগে, ওই সময়ে এমন গরম শুরু হয় যে ঘরেই থাকা যায় না। দিনের বেলায় মাঠে পা দেওয়া যায় না। মনে হয়, মাটির মধ্যে আগুন লাইগা রইছে। কাজকাম সব বন্ধ কইরা গাছের ছায়া খোঁজা লাগে, তা–ও যদি নিস্তার পাওয়া যাইতো!’

পেশা পরিবর্তন, চাপ বেড়েছে নদী–সাগরে

চালিতাবুনিয়ার আগুনমুখা নদীর পাড়ে বেল্লাল গাজীর (৫০) বাড়ি। গেরস্ত পরিবারের সন্তান বেল্লাল এখন অন্যের নৌকায় দিনমজুর খাটেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমগো বাড়িতে আগে কাজের লোক রাখা লাগত। দিন–রাত কাজ করত তারা!’

বেল্লাল গাজীর মতো কৃষকেরা এখন পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন। পটুয়াখালী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে পটুয়াখালীতে কৃষক পরিবার কমেছে প্রায় ৪০ হাজার বা ১৫ শতাংশ। আবার পেশা পরিবর্তন করা কৃষকদের বড় অংশ এখন জেলে হিসেবে নিজেদের পেশা বেছে নিয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়। রাঙ্গাবালীর আবদুল মালেক হাওলাদারের (৪৫) কথায় তার প্রতিফলনও দেখা গেছে। মালেক হাওলাদার বলেন, ‘আমার বাবা রুস্তম আলী হাওলাদার বড় গেরস্ত বংশের পোলা আছিল। সাত–আট বছর আগেও নিজের জমি থেকে ধান আসত। নদীতে সব হারায়ে এখন শুধু নামের লগে হাওলাদারই রইয়া গ্যাছে, কপালে হাওলাদার বংশের মর্যাদাটা নাই। এহন আমি অন্যের নৌকায় মাছ ধরি।’

জেলা মৎস্য কার্যালয়ের তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৮–১৯ অর্থবছর থেকে ২০২৩–২৪ পর্যন্ত ছয় বছরে সরকারি হিসাবে পটুয়াখালীতে ১০ হাজার জেলে বেড়েছে। সরকারের এই তালিকার বাইরেও অনেক জেলে আছেন। আগের তুলনায় জেলের সংখ্যা অনেক বেড়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, উপকূলীয় এই জেলার মানুষেরা ছোটবেলা থেকেই মাছ, জাল ও নৌকার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন, ফলে তাঁরা মাছ ধরায় পারদর্শী হন। কোনো উপায় না থাকলে তাঁরা নৌকা ও জাল নিয়ে নদী বা সাগরে মাছ ধরতে নেমে পড়েন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদী–সাগরে মাছ কমলেও জেলের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ফলে নদী ও সাগরে চাপ বেড়েছে।

দুঃখ বাড়ানো বন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র

পটুয়াখালীতে পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে পুরোদমে উৎপাদন চলছে। এর বাইরে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর অধীন কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন। আশুগঞ্জ পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সুপার থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সেগুলোর মধ্যে একটি। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে কলাপাড়ার ধানখালী ও চম্পাপুর ইউনিয়নের ৯২৬ একর জমি অধিগ্রহণ করে। পুরো এলাকাটিই নদীভাঙনপ্রবণ। এভাবে অন্যান্য তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণে অন্তত ৯ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেছে সরকার।

গত ৯ ডিসেম্বর চম্পাপুরের ঠিক মাঝামাঝি বাংলাবাজার নামের ছোট বাজারে শিপন হাওলাদারের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। তাঁর আড়াই একর জমির বেশির ভাগই অধিগ্রহণে নিয়েছে আশুগঞ্জ পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি। ক্ষতিপূরণ বাবদ পাওয়া টাকা ইতিমধ্যে নানা খাতে খরচ হয়েছে। এখন রুজি–রোজগারের ব্যবস্থা নেই।

প্রথম আলোকে শিপন হাওলাদার বলেন, ‘সব শেষ করে আধা কানি (৮০ শতক) জমি অবশিষ্ট আছে। জমিটা পাওয়ার প্ল্যান্টের (বিদ্যুৎকেন্দ্র) পাশে হওয়ায় আগের মতো ধান হয় না। দেখা যায়, গাছ কুঁকড়ায়ে গেছে বা ধানের শিষ ঠিকমতো বের হচ্ছে না। কয়টা কলাগাছ লাগাইছিলাম, কলার ছড়া বের হইছে কিন্তু কলা নাই।’

নজরুল ইসলামদের জমি ছিল ১০০ কানির ওপর। সব হারিয়ে এখন এই ঘর আর সামান্য কিছু জমি অবশিষ্ট আছে। গত ৫ ডিসেম্বর পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চালিয়াবুনিয়ায়
ছবি: প্রথম অালো

একই এলাকার দাদন হাওলাদার নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ায় ধোঁয়া ও গরমে নারকেলগাছ কালো হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ডাব হলুদ হয়ে যায়; নারকেল হওয়ার আগেই গাছ থেকে পড়ে যায়। তিনি বলেন, ‘আগে এমন হইতো না, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার পর দুই–তিন বছর ধরে এমন হইতেছে। গাছে আম–কাঁঠাল হয় না, ফলফলাদির গাছ লাগালে বাঁচে না। গরমকালে তো গরমের জন্য টেকাই যায় না; খেত–খামারে কাজ করার উপায় নাই।’

পায়রা সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ কলাপাড়ার লালুয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা জলিল সর্দারের (৫২) অন্তত পাঁচ একর জমি অধিগ্রহণ করেছে। ক্ষতিপূরণের টাকায় চার ছেলের জন্য জমি কিনে বাড়ি বানিয়েছেন জলিল, চাষের জন্য সামান্য জমি রেখেছেন। জলিল সর্দার বলেন, ‘সব করে টাহা নাই একটাও হাতে। পোলাপানগোরে তো খাওন দিতে অইবে। বড় ছেলেটারে আটকায়ে রাখতে পারি নাই। সে (সাইফুল ইসলাম) নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটা গার্মেন্টসে কাজ করে। বিয়ে-থা করে বউ-বাচ্চাসহ সেখানেই তাঁর সংসার।’

বাড়ছে নারীনির্ভর পরিবার

ষাটোর্ধ্ব রেজাউল তালুকদারের জীবন কেটেছে নদী আর সাগরে মাছ ধরে। ১০ বছর আগে তাঁর বড় ছেলেকে ফতুল্লায় পাঠিয়েছেন। দুই মেয়েরও বিয়ে দিয়েছেন ঢাকায়। রেজাউল বলেন, ‘এলাকায় কাজ নাই, টাকা–পয়সার জোগাড় নাই। আমার জীবন তো কাইটাই গ্যাছে। ছেলেমেয়েগুলা ভালো থাক; তাগোরে কাছে রাইখা হরমু কী!’

দুঃখ–দুর্দশা থেকে মুক্তি পেতে জেলার বাসিন্দারা বিদেশে যেতেও নানা জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছেন। কলাপাড়ার চম্পাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা দুবাইফেরত হিরন খান (৪০) বলেন, দুবাইয়ে দেশের মানুষ থাকলেও জেলার মানুষ কম। তাই বিদেশে গিয়ে সহযোগিতার অভাবে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যায়। এর বাইরে পারিবারিক নানা টানাপোড়েনের কারণে দেশে ফিরে আসছেন তাঁরা।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০২০–২১ থেকে ২০২৩–২৪ এই চার অর্থবছরে নোয়াখালীর তুলনায় অন্তত ১০ গুণ কম এবং ফেনীর তুলনায় সাড়ে ৮ গুণ কম প্রবাসী আয় এসেছে পটুয়াখালীতে। এই তিনটিই বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা।

‘ফুড ফর হাংরি’র অর্থায়নে সেন্টার ফর পিপল অ্যান্ড এনভায়রনের (সিপিই) সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, পটুয়াখালী জেলায় ২৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ মানুষ জীবিকার তাগিদে মৌসুমি অভিবাসন নিচ্ছে। গবেষণাটিতে দেখা গেছে, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী ও কলাপাড়ার অভিবাসনের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে নদীভাঙন, লবণাক্ততা এবং সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন কার্যক্রম। গবেষণাটির নেতৃত্ব দেওয়া সিপিইর পরিচালক আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এই অভিবাসনের কারণে নারীর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। অভিবাসিত পুরুষদের একটি বড় অংশ বহুবিবাহে জড়ান, তাঁরা আর এলাকায় ফেরেন না। এ কারণে তালাকের হার বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নারীনির্ভর পরিবারের সংখ্যা।

চম্পাপুরের বাংলাবাজারের পাশে নিপু আক্তার (৪২) স্থানীয় চেয়ারম্যানের সহায়তায় পাওয়া সরকারি বাড়িতে বাস করছেন। তিনি বলেন, ‘বিয়ের আগে বাপের সংসারে অভাব, বিয়ের পর স্বামীর সংসারে।’ সে সংসারও টেকেনি তাঁর। কয়েক বছর পর অভাবের কথা বলে ঢাকায় চলে যান তাঁর স্বামী। পরে শুনতে পান, স্বামী আরেকটা বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন।

নারীস্বাস্থ্য হুমকিতে

কলাপাড়ার চরকাউয়ার চরের সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য কুলসুম বেগম দীর্ঘদিন জরায়ুর সমস্যায় ভুগেছেন। তিনি বলেন, ‘মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতো। পটুয়াখালীতে চিকিৎসা শুরু করছিলাম। পরে ঢাকায় গিয়া চিকিৎসা করাইতে আর্থিকভাবে ভেঙে পড়া লাগছে। সেই ধকল এখনো কাটে না।’

কুলসুম বেগম জানান, এলাকাটিতে ভোটার আছে সাড়ে তিন হাজার; কিন্তু কোনো স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র নেই। চিকিৎসার জন্য হয় কলাপাড়া ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে, না হয় পটুয়াখালীতে যেতে হয়। ফলে কোনো সমস্যা হলে বেশির ভাগ নারীই সুস্থ হওয়ার দায় প্রকৃতির ওপর ছেড়ে দেন। ফলে দীর্ঘদিন শরীরের মধ্যে পুষে রাখতে রাখতে শরীরে বড় রোগ বাঁধে, মৃত্যু পর্যন্ত হয় নারীদের।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘বাংলাদেশে মাতৃ ও প্রসবকালীন মৃত্যু পর্যবেক্ষণ ও প্রতিক্রিয়া’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শুধু ২০২২ সালেই পটুয়াখালী জেলায় প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ২৯টি, নবজাতক মারা গেছে ১১৫টি। ধুলাসার ইউনিয়নের লায়লা বেগম বলেন, ‘ডাক্তার বা চিকিৎসা আমাদের জন্য না, এগুলো শহরের মানুষের জন্য। আমাদের কোনো অসুখ হলে আল্লাহর নাম নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।’

একশনএইড বাংলাদেশের উদ্যোগে ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড হেলথ ইন কোস্টাল বাংলাদেশ’ শিরোনামে চলমান এক গবেষণায় দেখা গেছে, কলাপাড়া উপজেলার ৪০০ তথ্যদাতার মধ্যে ৩০ শতাংশ নারী অনিয়মিত মাসিক, ১৫ শতাংশ মূত্রনালির সংক্রমণ, ১৫ শতাংশ ইউটেরিন ইনফ্ল্যামেশনসহ অন্যান্য রোগে ভোগেন। এই গবেষণায় সহযোগিতা করেছে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

জয়নব বিবি হাত উঁচিয়ে আগুনমুখা নদীর মাঝখানে নির্দেশ করে বললেন, সেখানে জমিজিরাত ঘরবাড়ি সব ছিল তাঁর। গোছানো সংসার এখন নদীগর্ভে। গত ৫ ডিসেম্বর পটুয়াখালীর চালিতাবুনিয়ায়
প্রথম আলো

বয়স ১৫ হওয়ার আগেই কলাপাড়ার ধুলাসার ইউনিয়নের চর কাউয়ার চরের মনোয়ারা বেগমের বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর থেকেই অতিরিক্ত ঋতুস্রাবের সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। পরে ডাক্তার দেখিয়ে জানতে পারেন, জরায়ুতে টিউমার হয়েছে। তিনটি অস্ত্রোপচার করে জরায়ু কেটে বাদ দিতে হয়েছে। মনোয়ারা প্রথম আলোকে বলেন, ‘লবণাক্ত পানি ব্যবহার করতে করতে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছি। আমাদের পাড়ার মধ্যেই এমন ১০-১৫ জন আছেন, যাঁদের জরায়ুতে সমস্যা।’

পটুয়াখালীর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক শরীফ শায়লা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিমাসে গড়ে ৫০ জন নারী জরায়ু ইনফেকশনের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আসেন। দেখা যায়, দীর্ঘদিন সমস্যাগুলো চেপে রেখে একদম শেষমূহূর্তে হাসপাতালে আসেন। ফলে অনেক সময় জরায়ু কেটে বাদ দিতে হয়।

সুপেয় পানির সংকট, নির্যাতনের শিকার নারী

ধুলাসার ইউনিয়নের গঙ্গামতির চরের রিনা বেগম লবণাক্ত পানির কারণে জরায়ুর ইনফেকশনে ভুগেছেন দীর্ঘদিন। এনজিওকর্মীদের মাধ্যমে জানতে পারেন, এই রোগের মূল কারণ লবণাক্ত পানির ব্যবহার। এই পানি ব্যবহার না করতে তাঁকে বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরের গভীর নলকূপ থেকে সুপেয় পানি আনতে হয়। রিনা বেগম বলেন, ‘শরীর খারাপ থাকলেও আমারেই সব করা লাগে। এত দূর থেকে পানি আনতে গিয়া হাঁপায়ে যাই, একটু জিরায়া দেরি করে বাড়ি ফিরলে স্বামীর সাথে কলহ বাধে, বেশ কয়দিন এমন হইছে।’

একশনএইডের ওই গবেষণায় দেখা গেছে, কলাপাড়ায় পানির দুষ্প্রাপ্যতা শুরু হয় জানুয়ারিতে, চলে মে পর্যন্ত। গবেষণায় তথ্যদাতাদের মধ্যে খাবার পানির জন্য কলাপাড়া উপজেলায় ৯০ শতাংশের বেশি বাসিন্দা গভীর নলকূপের ওপর নির্ভরশীল। সরেজমিনে দেখা গেছে, এলাকার সবার বাড়িতে গভীর নলকূপ নেই। বাড়ি থেকে এক–দুই কিলোমিটার দূরে দূরে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এসব নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহের কাজ নারীরাই করছেন।

বাড়ছে বাল্যবিবাহ

রাঙ্গাবালীর লায়লা বেগমের ৩০ বছরের সংসার, সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে তাঁর স্বামী অসুস্থ হন। বাধ্য হয়ে তাঁদের পঞ্চম শ্রেণিপড়ুয়া ছেলেটি এখন সংসারের হাল ধরতে সাগরে মাছ ধরার কাজ করছে। ছেলের আয়েই সংসার চলে। স্বামী ও উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন সন্তানকে ভালো রাখাই এখন লায়লা বেগমের প্রধান চিন্তা।

তিন বছর আগে বিয়ে হয় সাগরিকার, তখন বয়স ছিল ১৫, সবে নবম শ্রেণিতে উঠেছিল। কেউ বাধা দেননি। সাগরিকার ভাষ্য, এটাই চরাঞ্চলের নারীর জন্য চরম সত্য। বিয়ের দুই বছরের মধ্যে প্রথম সন্তানের জন্ম হয় তাঁর। গর্ভবতী অবস্থায় নানা জটিলতার মুখোমুখি তো হয়েছেনই, বাচ্চার জন্মের পর অতিরিক্ত মাসিকও শুরু হয় সাগরিকার।

সাগরঘেষাঁ পটুয়াখালীর চর গঙ্গামতিতে প্রায় ১০ হাজার মানুষের বাস। গঙ্গামতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশীষ কুমার কির্তনীয়া বলেন, জীবিকার জন্য ছোটবেলা থেকে পরিবারের বাবা অথবা ভাইয়ের সঙ্গে মাছ ধরতে সাগরে যায় শিশুরা। ফলে শিশুদের পক্ষে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোনোও সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, তাঁর স্কুলে বর্তমানে ১৭২ জন ছাত্র আর ছাত্রী ৭৮ জন। দিন যত যাচ্ছে, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা তত কমছে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সাবিনা ইয়াসমিন]