জ্বালানি খাতের দুর্নীতি ঢাকতে বাতিল প্রকল্প চালুর চক্রান্ত করছে সরকার: আনু মুহাম্মদ

ফুলবাড়ী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য দিচ্ছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। শুক্রবার দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলায়
ছবি: প্রথম আলো

তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ–বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি এবং পরিকল্পনা ছাড়াই উপকূলীয় অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। কোনো ধরনের বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে গত ১১ বছরে ৯০ হাজার কোটি টাকা সরকারের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কতিপয় মুনাফাখোর ব্যক্তি। সরকার একদিকে অনিয়ম-দুর্নীতি ঢাকার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট দেখিয়ে ফুলবাড়ীতে আবার কয়লা উত্তোলনের নতুন ষড়যন্ত্র করছে। আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সর্বনাশা এই প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রতিহত করবে ফুলবাড়ীর মানুষ।’

আজ শুক্রবার সকালে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলায় ‘ফুলবাড়ী দিবসের ১৬ বছর পূর্তি’ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ–বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ফুলবাড়ী শাখার আহ্বায়ক সৈয়দ সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আমিনুল ইসলাম, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের নেতা মোশাররফ হোসেন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মেহেরুল ইসলাম, ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা হবিবর রহমান, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন প্রমুখ।

এর আগে সকাল আটটা থেকে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা ও স্থানীয় মানুষ উপজেলা শহরের নিমতলা মোড়ে জড়ো হন। সেখান থেকে একটি শোভাযাত্রা বের করে শহর প্রদক্ষিণ করে ফুলবাড়ী আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সেখানেই প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

ফুলবাড়ী দিবস উপলক্ষে শোভাযাত্রা। শুক্রবার দিনাজপুরের ফুলবাড়ী শহরের নিমতলা এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ফুলবাড়ী থেকে কয়লা তুলতে গত ১৬ বছরে অনেকবার চক্রান্ত করা হয়েছে। এশিয়া এনার্জি চুক্তি ছাড়াই ফুলবাড়ীর কয়লাখনি দেখিয়ে লন্ডনের শেয়ারবাজারে ব্যবসা করছে। লাভের টাকায় দেশীয় কিছু দালাল পুষছে। মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ ও মিডিয়ার মধ্যে একটি গোষ্ঠী তৈরির চেষ্টা করছে। সরকার বিভিন্ন ইস্যুতে অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেও এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, ২০১৭ সালে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ–বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি সরকারকে দেশীয় গ্যাস সম্পদের সঙ্গে নবায়নযোগ্য জ্বালানির মিশ্রণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মহাপরিকল্পনা গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু সরকার তা না করে অন্য দেশ থেকে আমদানিনির্ভর প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এমনভাবে চুক্তি করা হয়েছে, যা সাধারণ মানুষের ওপর একটি চিরস্থায়ী বোঝায় পরিণত হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ একটা অজুহাত মাত্র। যুদ্ধ না হলেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ত বলে তিনি মন্তব্য করেন।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, মানুষের সর্বনাশ করে বাংলাদেশে কোনো কয়লাখনি হবে না। দেশ-বিদেশের লুটেরা গোষ্ঠী আছে, তারা মুখে মধুর কথা বলে আবার কয়লা উত্তোলনের পাঁয়তারা করছে, তাদের চিহ্নিত করে জনগণের আদালতে দাঁড় করানো হবে। আগামী সেপ্টেম্বরে ফুলবাড়ীতে জ্বালানিবিষয়ক একটি সেমিনার করা হবে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ফুলবাড়ী আন্দোলনের ছয় দফা দাবির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হলে চক্রান্তকারীদের পরাস্ত করে ফুলবাড়ী তথা দেশের মানুষ মুক্তির ঠিকানা খুঁজবে।

উল্লেখ্য, ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন বন্ধের দাবিতে বহুজাতিক কোম্পানি এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে স্থানীয় বাসিন্দারা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে তিন যুবক নিহত হন এবং আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। এ ঘটনায় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন বন্ধ , আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারসহ ছয় দফা দাবি তোলেন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ–বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ও ফুলবাড়ীর সাধারণ মানুষ।

চালু আছে এশিয়া এনার্জির ওয়ার্কশপ ও কার্যালয়

ফুলবাড়ীতে আন্দোলনের মুখে এশিয়া এনার্জির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তবে আন্দোলনের ১৬ বছর পেরিয়ে গেলেও শহরের অদূরে ফকিরপাড়া এলাকায় এখনো কোম্পানিটির ওয়ার্কশপ ও উত্তর সুজাপুর এলাকায় কার্যালয় আছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এশিয়া এনার্জির লোক গোপনে কার্যালয়ে আসেন। এলাকার কতিপয় মানুষের সঙ্গে কোম্পানিটির প্রতিনিধিদের যোগাযোগ আছে। তবে তারা কয়লা উত্তোলনের চেষ্টা করলে কঠোরভাবে দমন করবেন তাঁরা।

শুক্রবার সকালে ফকিরপাড়া এলাকায় কোম্পানিটির ওয়ার্কশপে নিরাপত্তা প্রহরী খন্দকার আহসান হাবিবের সঙ্গে কথা হয়। জানালেন, সাড়ে ১২ বছর ধরে চাকরি করছেন তিনি। দুই কার্যালয়ে কেয়ারটেকার পদে ১০ জন কর্মচারী আছেন। মাসিক বেতন পান ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা। ব্যাংকের মাধ্যমে প্রতি মাসে নিয়মিত বেতন পান তাঁরা। মাঝেমধ্যে কোম্পানির প্রতিনিধিরাও আসেন। খোঁজখবর নিয়ে চলে যান।