৪২ বছরের অভিজ্ঞতায় টানা দুবার দেশসেরা চা চয়নকারী জেসমিন
১৬ বছর বয়সে চা-শ্রমিক আবদুল বারেকের সঙ্গে বিয়ে হয় জেসমিন আকতারের (৫৮)। দরিদ্র স্বামীর সংসারে সচ্ছলতা আনতে বিয়ের তিন মাসের মাথায় বাগানে চা-পাতা তোলার কাজ নেন। ৪২ বছর ধরে সে কাজই নিষ্ঠার সঙ্গে করে চলেছেন তিনি। দীর্ঘদিনের এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কম সময়ে সবচেয়ে বেশি চা–পাতা তোলায় দেশসেরার স্বীকৃতি পেয়েছেন এই চা–শ্রমিক।
শ্রেষ্ঠ চা-পাতা চয়নকারী শ্রমিক হিসেবে জাতীয় চা পুরস্কার ২০২৫ পেয়েছেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নেপচুন চা–বাগানের চা–শ্রমিক জেসমিন আকতার। জাতীয় চা দিবস উপলক্ষে গত ২১ মার্চ (বুধবার) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাঁর হাতে এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। শুধু এবারই নয়, ২০২৪ সালেও শ্রেষ্ঠ চা-পাতা চয়নকারীর স্বীকৃতি পেয়েছিলেন জেসমিন আকতার।
জেসমিনের সাফল্যের গল্প জানতে গত সোমবার বিকেলে নেপচুন চা-বাগানের ব্যবস্থাপকের কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, বাগানে চা-পাতা তোলার কাজ করছেন জেসমিন। কার্যালয়ে পাওয়া যায় তাঁর বড় ছেলে একই বাগানের শ্রমিক মুহাম্মদ আলামিনকে। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেলে বাগানের পথ ধরে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার যাওয়ার পর দেখা হয় জেসমিন আকতারের সঙ্গে। পাহাড়ের ঢালুতে বাগানে তখন তিনি ১০-১৫ জন সহকর্মীর সঙ্গে দু-হাত চালিয়ে পাতা তোলায় ব্যস্ত। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই একটি কুঁড়ি দুটি পাতা ঘিরে বহমান জীবনের গল্প শোনালেন তিনি।
বিয়ের তিন মাসের মাথায় বাগানে যোগদান
জেসমিন আকতারের বাবার বাড়ি কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলায়। স্বামীর বাড়ি একই জেলার মুরাদনগরে। তবে স্বামী ছিলেন নেপচুন চা-বাগানের নৈশপ্রহরী। বিয়ের পর জেসমিনকে স্বামীর সঙ্গে চলে আসতে হয় বাগানে। মাস তিনেক পর স্বামীর কষ্ট দেখে স্থির করলেন তিনি নিজেও বাগানে কাজ করবেন। স্বামীর হাত ধরে একদিন বাগান ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলে চা চয়নকারী হিসেবে যোগ দেন।
কথায় কথায় জেসমিন যেন পুরোনো দিনে ফিরে যান। বলেন, শ্বশুরবাড়ি ও বাবার বাড়ির লোকজন গরিব ছিলেন। স্বামী একা সব সামলাতে কষ্ট পাচ্ছিলেন। দুজন মিলে আয় করে সংসারে সচ্ছলতা আনার চিন্তা থেকে নববধূ অবস্থায় বাগানে যান তিনি। কোনো বাধাবিপত্তি এসেছে কি না জানতে চাইলে জেসমিন বলেন, মাতৃত্বকালীন সময়ে কিছুটা সমস্যা হয় কয়েক মাস, তবে বাধা আসেনি। ওই সময়ে বাগান কর্তৃপক্ষ শিশুকে দেখভালের ব্যবস্থা করে। এভাবে তাঁরা বাগানে কাজ করতেন।
জেসমিন জানান, চা–বাগানে কাজ করতে করতে এক ঘণ্টায় তিনি সর্বোচ্চ ৪৮ কেজি চা–পাতা তুলেছেন। দৈনিক ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করে পাতার পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা মজুরি পেয়েছেন।
জেসমিন আকতারের স্বামী আবদুল বারেক দুই বছর আগে চাকরি ছেড়েছেন। এখন ঘরে অবসর সময় কাটান। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে এই দম্পতির সংসার।
সাফল্যের নেপথ্যে পরিশ্রম, একাগ্রতা আর কৌশল
জেসমিন আকতার চা-পাতা তুলতে ভোরবেলা বাড়ি থেকে বের হন। সারা দিন পাতা তোলা শেষে ফেরেন সন্ধ্যায়। কাজের ফাঁকে বিরতিও কম নেন। এসব কারণেই সফলতা এসেছে বলে মনে করেন তিনি।
বেশি পাতা তোলার কৌশল সম্পর্কে জেসমিন আকতার বলেন, তিনি ভোর পাঁচটায় বের হন। হাত চালু করে কাজ করেন। কোনো অলস সময় পার করেন না। কাজের ফাঁকে বিরতিও কম দেন। আর আড়াই পাতি পাতা (দুটি পাতা একটি কুঁড়ি) একসঙ্গে তুলে নিলে ভালো হয়।
রোদ-বৃষ্টি হোক আর প্রতিকূল পরিবেশ হোক না কেন, কখনো থেমে থাকেননি উল্লেখ করে জেসমিন বলেন, ‘শুধু পরিশ্রম করলেই হয় না, কৌশলও জানতে হয়। সবাই পাতা তোলে রুটিন অনুসারে। কিন্তু সবাই তো আর দেশসেরা হতে পারে না। এ জন্য দরকার দ্রুততার সঙ্গে বেশি পাতা তোলার কৌশল। দুই হাত সমানতালে চালিয়ে কাজ করেছি। সফলতা পেয়েছি। এক ঘণ্টায় সর্বোচ ৪৮ কেজি চা–পাতা তুলেছি। দিনে আড়াই শ কেজিও হয়।’
দুপুরের খাবার সকালে সঙ্গে নিয়ে বের হন জেসমিন। বাগানে কাজের ফাঁকে খেয়ে নেন। ১২ ঘণ্টা কাজের মধ্যে ১ ঘণ্টা পারলে জিরিয়ে নেন। দাদি জেসমিনের সঙ্গে শখে বাগানে কাজ দেখতে এসেছিল মাদ্রাসাপড়ুয়া নাতনি চাঁদনী আক্তার। সে বলে, ‘দাদি সেরা পুরস্কার পেয়েছে, তাতে আমরা অনেক খুশি।’
জেসমিনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাঁর আরও কয়েকজন সহকর্মী এগিয়ে আসেন। তাঁদের একজন দিপা ঘাষি বলেন, ‘জেসমিন আপা পরিশ্রম করে সফলতা পেয়েছেন। কারণ, তিনি খুব কম সময়ে বেশি পাতা তোলেন। কাজও করেন বেশি। তিনি যে জাতীয় পুরস্কার পেলেন, এটা আমাদের জন্য অনেক আনন্দের। তাঁর দেখায় আমরা সাহস করি, একদিন আমরাও সেরা চয়নকারী হব।’
যেভাবে সেরা হলেন জেসমিন
বাগানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক বছরে সর্বোচ্চ চা–পাতা সংগ্রহকারীদের তালিকা বাগান থেকে চা বোর্ডে জমা দেওয়া হয়। বোর্ড কর্তৃপক্ষ যাচাই–বাছাই করে বিভিন্ন বাগান থেকে সেরা তিন চা–শ্রমিককে নির্বাচিত করে। এরপর ওই তিনজনকে অন্য একটি চা–বাগানে নিয়ে ৩০ মিনিটের জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। নির্ধারিত সময়ে যিনি সবচেয়ে বেশি পাতা তুলতে পারেন, তিনি হন বিজয়ী।
নেপচুন চা-বাগান কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেসমিন আকতার ২০২৪ সালে মোট ৩৪ হাজার ৯৩৭ কেজি চা–পাতা তুলেছিলেন। এর আগের বছর তিনি ২৫ হাজার ২১৭ কেজি পাতা তুলেছিলেন। পাতার মানভেদে ওজনে পার্থক্য হয়ে থাকে।
২০২৪ সালের সর্বোচ্চ চা–পাতা উত্তোলনকারী শ্রমিকদের মধ্যে ৮ মে ফটিকছড়ির হালদাভ্যালি চা–বাগানে প্রতিযোগিতা হয়। ওই দিন জেসমিন আক্তার আধা ঘণ্টায় ১৩ দশমিক ২৫ কেজি চা–পাতা উত্তোলন করে শ্রেষ্ঠ পাতা চয়নকারী নির্বাচিত হন। আগের বছরে হওয়া প্রতিযোগিতায় জেসমিন আকতার আধা ঘণ্টায় পাতা তুলেছিলেন ২৪ কেজি।
জেসমিনের কাজ দেখভালের দায়িত্বে আছেন বাগানের সরদার পরীক্ষিত তাতী। তিনি জানান, তাঁরা শ্রমিকদের কীভাবে পাতা তুলবেন তা শিখিয়ে দেন। ১০০ জন শ্রমিকের সঙ্গে তাঁরা ১০ থেকে ১২ জন থাকেন দেখভালের কাজে। জেসমিনের অর্জনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শ্রমের মূল্যায়ন পেয়েছে সে। এটা আমাদের জন্য গর্বের। সেটা তার প্রাপ্য ছিল।’
সেরা চা চয়নকারী হিসেবে জেসমিন আকতারের পুরস্কার ছিল এক ভরি স্বর্ণালংকার বা ১ লাখ ৫১ হাজার টাকা। তবে তিনি গরিব মানুষ। তাই সোনা নিতে অনাগ্রহ দেখালে তাঁকে সমপরিমাণ টাকা দেওয়া হয়।
বাবা-মায়ের হাত ধরে জেসমিনের বড় ছেলে আলামিনও একই বাগানে শ্রমিকের কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘আমার বুদ্ধির বয়স থেকে দেখছি মা মাসে ৩০ দিনে ৩০ দিনই কাজ করেন। কঠোর পরশ্রম করেন। ওনার দেখায় বাগানের অন্য কর্মীরাও বেশি পাতা তোলার কাজে উৎসাহ পান।’
৬৫ বছরের সাজানো-গোছানো বাগান
বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৬০ সালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার নারায়ণহাট ইউনিয়নে ২ হাজার ৭০০ একর আয়তনবিশিষ্ট পাহাড়-সমতল এলাকায় গড়ে ওঠে ইস্পাহানি গ্রুপের নেপচুন চা–বাগান। ২০০৯ সালে বৃক্ষরোপণে দেশসেরা চা–বাগান মনোনীত হয় বাগানটি। ২০২০ সালে গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড মনোনীতও হয় এ বাগান।
সরেজমিন বাগান ঘুরে দেখা যায়, বিশাল আয়তনের পরিচ্ছন্ন বাগনটি দেখতেও দৃষ্টিনন্দন। বাগানের পাহাড়ের বুক চিরে চলে গেছে একাধিক সড়ক। বাগানের ফাঁকে ফাঁকে শ্রমিকদের আবাসিক বাড়িঘর। ঘুরতে আসেন অনেক ভ্রমণপিপাসুও।
দীর্ঘ ৬৫ বছরের যাত্রায় এ বাগান নানা সফলতার পাশাপাশি চা উৎপাদনেও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। ২০২৩ সাল থেকে দেশসেরা চা–পাতা চয়নকারী জাতীয় পুরস্কার আয়োজন করে চা বোর্ড। সেই থেকে পরপর তিনবারই নেপচুন চা–বাগানের দুই শ্রমিক পুরস্কারটি পেয়ে আসছেন। ২০২২ সালে দেশসেরা চা-শ্রমিক নির্বাচিত হয়েছিলেন একই বাগানের উপলক্ষ্মী ত্রিপুরা।
বাগানের উন্নত পরিবেশ, আনন্দঘন পরিবেশে কাজের সুযোগ, মানসম্পন্ন আবাসন ও রাস্তাঘাট থাকার ফলে শ্রমিকেরা মনের আনন্দে বাগানে কাজ করতে পারেন বলে মনে করেন নেপচুন চা–বাগানের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক মুহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিকদের কাজের দক্ষতা উন্নয়নে বছরে কয়েকবার চা গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের এনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তা ছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় এবং অন্যান্য উৎসবে নানা সুবিধা দেওয়া হয়। আনন্দ উদ্যাপনের ব্যবস্থা করা হয়। শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখায়ও তদারক করে বাগান কতৃর্পক্ষ। সব মিলিয়ে শ্রমিকেরা মনের আনন্দে কাজ করার পরিবেশ পাওয়ায় বারবার ভালো ফল বয়ে আনছেন।
মুহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘জেসমিন দ্বিতীয়বারের মতো শ্রেষ্ঠ চা–পাতা চয়নকারী হিসেবে এ পুরস্কার পেয়েছেন। সারা দেশের ১৬৮টি বাগানের শ্রমিকদের মধ্য থেকে তিনি সেরার পুরষ্কার পেয়েছেন, এটা আমাদের জন্য অনেক আনন্দের।’