কর্নেল মালেক হাসপাতাল
ডেঙ্গু রোগীদের ভোগান্তি
টিকিট কাটা, রক্ত জমা দেওয়া, ডেঙ্গু পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া, চিকিৎসক দেখানো প্রতিটি ক্ষেত্রেই দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়।
ডেঙ্গু পরীক্ষার প্রতিবেদন (রিপোর্ট) পেতে বিলম্ব হওয়ায় বাধ্য হয়ে হাসপাতাল–সংলগ্ন বিভিন্ন বেসরকারি রোগনির্ণয় কেন্দ্র থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাচ্ছেন স্বজনেরা। শয্যাসংকটের কারণে হাসপাতালের মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে অনেক ডেঙ্গু রোগীকে। এ চিত্র মানিকগঞ্জ কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে এই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু ইউনিটে ভর্তি অন্তত ১০ জন রোগী এবং স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের ভোগান্তির কথা জানা গেছে। তাঁরা জানান, হাসপাতালে টিকিট কাটা, রক্ত জমা দেওয়া, ডেঙ্গু পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়া, চিকিৎসক দেখানো এবং ওষুধ সংগ্রহ করা প্রতিটি ক্ষেত্রেই দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকেই বাইরে গিয়ে ডেঙ্গুসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন।
এ মেডিকেল কলেজে ডেঙ্গু আক্রান্ত সন্তানের চিকিৎসায় তিক্ত অভিজ্ঞতা ও ক্ষোভের কথা ফেসবুকে পোস্ট করেছেন লেখক ও ব্যবসায়ী বিনয় কর্মকার। তাঁর বাড়ি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলায়। পোস্টের শেষ অংশে তিনি লিখেছেন, ‘হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে হাসপাতালের নামে শুধু বড় বড় বিল্ডিং (ভবন) বানিয়ে জনগণের কী উপকার হচ্ছে? বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী আমাদের মানিকগঞ্জের, ওনার পিতার নামেই হাসপাতাল, অথচ ভেতরে চিকিৎসার এই অবস্থা! এগুলো দেখার যেন কেউ নেই। আমরা যেন এক হীরক রাজার দেশে বাস করছি!’
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩ হাজার ছাড়িয়েছে। এ পর্যন্ত জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সকাল ছয়টা থেকে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ৩৪৪ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এ সময়ের মধ্যে নতুন ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১২৮। এর মধ্যে কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫৮ জন, জেলা সদর হাসপাতালে ১৯ জন, সাটুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১১, সিঙ্গাইর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪, ঘিওর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৭, শিবালয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬ এবং মুন্নু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৩ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। এ ছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরাও চিকিৎসকের পরামর্শে বাড়িতেও চিকিৎসা নিচ্ছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজের ষষ্ঠতলায় ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় ৯০ শয্যার পৃথক দুটি ইউনিট খোলা হয়েছে। শয্যায় সংকুলান না হওয়ায় মেঝেতেও ভর্তি রয়েছেন অনেক রোগী। এসব রোগীকে মশারি টাঙানো ছাড়াই রাখা হয়েছে। এ ছাড়া শয্যাতেও অনেক রোগী মশারি টাঙানো ছাড়াই চিকিৎসা নিচ্ছেন।
অনেকে আসছেন ডেঙ্গুর পরীক্ষা করার জন্য। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সারিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে পরীক্ষা করানো যাচ্ছে না। রোগী ও তাঁদের স্বজনদের চাপ সামাল দিতে হাসপাতালের স্বেচ্ছাসেবকেরা হিমশিম খাচ্ছেন। আবার রিপোর্ট পাওয়ার জন্য একই রকম ভোগান্তি ও সময় নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া হাসপাতালের টিকিট কাউন্টার, ডেঙ্গু পরীক্ষায় বুথ, ওষুধ কাউন্টার, প্যাথলজি বিভাগ, রিপোর্ট সংগ্রহ করার রুমেও মানুষের উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়।
হাসপাতালে ডেঙ্গু ইউনিটে ভর্তি জেলার হরিরামপুর উপজেলার সুরাই গ্রামের মিঠু মিয়া (১৮)। সঙ্গে থাকা বড় বোন বিউটি আক্তার বলেন, ‘ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে পরীক্ষা করলে পরের দিন রিপোর্ট দেয়। ভাইয়ের অবস্থা ভালো না হওয়ায় বাইরে থেকে পরীক্ষা করাইছি। এক দিনেই রিপোর্ট পাইছি।’
সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি ৫০ টাকা। বেসরকারি রোগনির্ণয় কেন্দ্রে ৩০০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে সরকারের এই নির্দেশনাও কোনো কোনো রোগনির্ণয় কেন্দ্র মানছে না। হাসপাতালে ভর্তি ঘিওর উপজেলার পেঁচারকান্দা গ্রামের সুবল বৈরাগী (৬০)। তাঁর মেয়ে বাসনা বৈরাগী বলেন, গত বুধবার জন্মাষ্টমীতে হাসপাতাল বন্ধ ছিল। হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে ল্যাব ওয়ান মেডিকেল সেন্টার নামের একটি বেসরকারি রোগনির্ণয় কেন্দ্রে গিয়ে ৪০০ টাকায় তাঁর বাবার ডেঙ্গুর পরীক্ষা করান।
ডেঙ্গু ইউনিটে ভর্তি রোগীদের ভোগান্তি ও তাঁদের স্বজনদের অভিযোগের বিষয়ে কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো. আরশাদ উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, শয্যার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হওয়ায় মেঝেতেও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে চিকিৎসার তেমন কোনো ঘাটতি নেই। ডেঙ্গু পরীক্ষার রিপোর্ট বিলম্বে পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, হাসপাতালে ভর্তি বিপুল পরিমাণ রোগীর প্রতিদিনই ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হয়। এ ছাড়া অন্য রোগীদেরও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। এ ছাড়া জনবলসংকটও রয়েছে। তবে এ সমস্যা দ্রুতই কেটে যাবে।