যশোরে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই ‘ভুঁইফোড়’

যশোরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমোদন পেয়েছে হিউম্যান রাইটস ভয়েস নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের কোনো কার্যক্রমের বিষয়ে আশপাশের মানুষ জানেন না। রোববার দুপুরে যশোর শহরের কারবালা সড়কেছবি: প্রথম আলো

যশোরের ৬টি আসনে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য যে ২১ পর্যবেক্ষক সংস্থাকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) অনুমোদন দিয়েছে, তার একটি ‘হিউম্যান রাইটস ভয়েস’। তাদের কার্যালয়ের ঠিকানা দেওয়া শহরের কারবালা সড়কের একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায়। রোববার ওই ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, সেটি বজ্রকলম নামের সাপ্তাহিক একটি পত্রিকার কার্যালয়। ওই কার্যালয়ের সামনেই হিউম্যান রাইটস ভয়েসের সাইনবোর্ড লাগানো। কার্যালয়টি বন্ধ। দরজার তালায় এত ধুলা যে বোঝা যাচ্ছে, অনেক দিন এটি খোলা হয় না।

আশপাশের লোকজনের কাছে হিউম্যান রাইটস ভয়েস সম্পর্কে জানতে চাইলে তাঁরা কিছু বলতে পারেননি। তাঁরা বলেন, প্রতিষ্ঠানটি কী কাজ করে, তা তাঁরা জানেন না। কার্যালয়টি প্রায় সময় বন্ধ থাকে। এমন একটি প্রতিষ্ঠান নির্বাচন পর্যবেক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাওয়ায় তাঁরা বিস্মিত।

পরে প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে দেওয়া মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে নূরুল আমিন নামের একজন ধরেন। তিনি নিজেকে বজ্রকলম সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক দাবি করেন। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক হিসেবেও পরিচয় দেন। বলেন, ‘অন্য একদিন আসবেন। সামনাসামনি কথা বলব।’ তাঁকে তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষক কতজন থাকবেন, তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় আছে কি না, প্রত্যেককে কত টাকা সম্মানী দেওয়া হবে, কোন কোন আসনে তাঁরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে কি না—এসব প্রশ্ন করলে তিনি দাবি করেন, যশোরের ৬টি আসনে তাদের ৬০ জন পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকবেন। তাঁদের কেউ রাজনীতিতে সক্রিয় নন। তবে সমর্থক কেউ থাকতে পারেন। সংস্থায় বেতনভুক্ত কোনো কর্মী নেই। সদস্যরা পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁদের কোনো টাকাপয়সা দেওয়া হবে না।

পরে নুরুল আমিন সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি যশোর জেলা জাতীয় পার্টির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক। তিনি এখন জাতীয় পার্টির সমর্থক।

নির্বাচন পর্যবেক্ষণে দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। এতে যশোরের ৬টি আসনে ২১টি পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠানের ৯১৭ জন পর্যবেক্ষক ভোটকেন্দ্রে পর্যবেক্ষণের অনুমতি পেয়েছেন।

তালিকার বাকি ২০টি প্রতিষ্ঠান হলো মানবাধিকার ও সমাজ উন্নয়ন সংস্থা (মওসুস), সোশ্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (সাকো), লুৎফর রহমান ভূঁইয়া ফাউন্ডেশন (এলআরবি), ডেভেলপমেন্ট পার্টনার (ডিপি), বিবি আছিয়া ফাউন্ডেশন, জানিপপ—জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ, বাঁচতে শেখা, ইন্টারন্যাশনাল আসফ লিগ্যাল এইড ফাউন্ডেশন, বিয়ান মানি সোসাইটি, পিপলস অ্যাসোসিয়েশন ফর সোশ্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট (পাশা), সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন, ডেভেলপমেন্ট পার্টনার (ডিপি), প্রকাশ গণকেন্দ্র (পিজিকে), ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইইডি), সমাজ উন্নয়ন প্রয়াস, সংগতি সমাজকল্যাণ সংস্থা, বঞ্চিতা সমাজকল্যাণ সংস্থা, ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম, সুফিয়া হানিফ ফাউন্ডেশন ও রাজারহাট স্বাবলম্বী সংস্থা।

এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যশোরে তিনটি সংস্থার কার্যক্রম পেয়েছে প্রথম আলো। তাদের কার্যক্রমও আছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো নামসর্বস্ব। তাদের দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ের সামনে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। নিজস্ব কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীও নেই।

এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিজ ইন বাংলাদেশ (এডাব) যশোরের সহসভাপতি শাজাহান নান্নু বলেন, ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ইসির তালিকায় যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, তার মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আছে। অধিকাংশ সংস্থা ভুঁইফোড় ও অস্তিত্বহীন।’

যেসব প্রতিষ্ঠান নির্বাচন পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পেয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আগেই গোয়েন্দা প্রতিবেদন ইসিতে পাঠানো হয়। পরে যাচাই-বাছাই করে এসব সংস্থাকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমোদন দিয়েছে ইসি।

ইসির তালিকায় থাকা বঞ্চিতা সমাজকল্যাণ সংস্থা যৌনকর্মীদের অধিকার ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করে। তাদের কার্যালয় শহরের লোহাপট্টি বাবুবাজার এলাকায়। প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ সম্পাদক হামিদা খাতুন বলেন, ‘নির্বাচনে পর্যবেক্ষণের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। এবারই প্রথম যশোর-৩ (সদর) আসনের জন্য ৪০ জন পর্যবেক্ষক ঠিক করা হয়েছে। তাঁদের কী সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে, তা এখনো আলোচনা হয়নি।’ কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও নির্বাহী পরিচালক কারও রাজনৈতিক পদ-পদবি নেই বলে তিনি দাবি করেন।

বাঁচতে শেখা নামের প্রতিষ্ঠানটির শহরের আরবপুর এলাকায় কার্যালয় ও কার্যক্রম আছে। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক পলাশ হিউবার্ট বলেন, ১৯৯৬ সাল থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষকের কাজের অভিজ্ঞতা তাঁদের আছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য কোনো সম্মানী নিয়ে এখনো কথা হয়নি। তাঁদের ১২ জন নিজস্ব কর্মী। যশোর-৩ আসনে ১২ জন পর্যবেক্ষক দেওয়ার জন্য তালিকা রিটার্নিং কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।

ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইইডি) নামের প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় শহরের ঘোপ নওয়াপাড়া সড়কে। প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি বীথিকা সরকার বলেন, ‘এটা আমাদের কেন্দ্র অফিস। প্রধান কার্যালয় ঢাকায়। এই নির্বাচনে পাঁচজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হবে। যাঁরা পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকবেন, তাঁদের সবাই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কর্মী।’

এ বিষয়ে যশোর জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘এনজিও মাসিক সমন্বয় সভায় যেসব প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়, সেসব প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা আমাদের কাছে আছে। সেখানে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পাওয়া ২১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কয়েকটির ঠিকানা ও প্রতিনিধির নাম আমাদের কাছে আছে। অন্যগুলোর বিষয়ে বলতে পারছি না।’ তবে কয়টির ঠিকানা আছে, তা তিনি স্পষ্ট করে বলেননি।

এ বিষয়ে জেলার জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা আনিচুর রহমান বলেন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ইসি যে তালিকা প্রকাশ করেছে, সেটা যশোর কার্যালয়ের তৈরি করা নয়। প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকাতে সরাসরি আবেদন করেছে, ঢাকা থেকে যাচাই-বাছাই করে ইসি নির্বাচন পর্যবেক্ষকের চূড়ান্ত অনুমতি দিয়েছে।