ভোলায় পুকুর ভেসে মাছ নদী-খালে, খামারিদের ব্যাপক ক্ষতি

জোয়ার–জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। জাঙালিয়া নদীতে সেই মাছ ধরছেন জেলেরা। গতকাল সোমবার ভোলা সদর উপজেলার সদু চর এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

ভোলা সদর উপজেলার চরসামাইয়া শান্তিরহাট বাজার। সাধারণত বিকেল কিংবা রাতে ওই বাজারে মাছ তেমন পাওয়া যায় না। তবে সপ্তাহ খানেক ধরে সেখানে ওই সময়ে মাছ বিক্রি হচ্ছে। তবে ওই সব মাছ আকারে কিছুটা ছোট।

স্থানীয় জেলেদের কাছ থেকে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে পুকুর ও ঘের ভেসে গেছে। সেখানকার মাছ ছড়িয়ে পড়েছে নদী ও খালে। জেলেরা ওই উন্মুক্ত জলাশয় থেকে সেসব মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করছেন।

গত ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় রিমাল উপকূলে আঘাত হানে। এর প্রভাবে উঁচু জোয়ার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভোলা জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের সূত্রে জানা যায়, ভোলার ৭টি উপজেলার ৫০টি ইউনিয়নে ৯ হাজার ৯২৮টি পুকুর ও ১ হাজার ৪৩৯টি ঘের প্লাবিত হয়েছে, যার আয়তন ৩ হাজার ২০ একর। সব মিলিয়ে ক্ষতি হয়েছে ২২ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১২ হাজার মৎস্য খামারি।

গত কয়েক দিন ভোলা সদর, দৌলতখান ও বোরহানউদ্দিন উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, নদী ও খালের তীরের অধিকাংশ ঘের-পুকুর পানিতে তলিয়ে আছে। জলোচ্ছ্বাসে অনেক ঘেরের পাড় ভেঙে গেছে। সদর উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাছের চাষ হয় চরসামাইয়া ইউনিয়নে। শুধু জাঙ্গালিয়া নদীর তীরেই আছে শতাধিক ঘের। সেখানকার খামারিরা জানান, গত ৫০-৬০ বছরে এত পানি কখনো হয়নি। নানা রকম নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়ার পরও ঘের-পুকুরের তীর ভেঙে গেছে। মাছ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।

ভোলার ৭টি উপজেলার ৫০টি ইউনিয়নে ৯ হাজার ৯২৮টি পুকুর ও ১ হাজার ৪৩৯টি ঘের প্লাবিত হয়েছে, যার আয়তন ৩ হাজার ২০ একর। সব মিলিয়ে ক্ষতি হয়েছে ২২ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১২ হাজার মৎস্য খামারি।

চরসামাইয়া ইউনিয়নের বড় চর সামাইয়া গ্রামে মৎস্য খামারির সংখ্যা দুই শতাধিক। তাঁরা জানান, এ গ্রামে অন্তত ৩০০ একর জমিতে মাছের চাষ হয়। ঘূর্ণিঝড়ে ২০০ খামারির অন্তত ২০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। সাধারণত নদীর পানি খামারে ঢুকিয়ে পাঙাশ ও তেলাপিয়ার চাষ করেন। বছরে দুইবার মাছ বিক্রি করেন। শীত শেষ না হতে ফাল্গুনের শুরুতে একদফা মাছ ছেড়েছিলেন। সেই মাছ জ্যৈষ্ঠ মাসে বিক্রি শুরু করার কথা। কিন্তু মাছ বিক্রির আগেই ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হেনেছে। এখন পানি কমিয়ে আবার মাছ ছাড়তে হবে।

মাকুসুদুর রহমান নামের একজন মৎস্য খামারি বলেন, তাঁর ৪০ একর খামারে তিন কোটি টাকা লগ্নি করা আছে। এর মধ্যে ব্যাংকে ঋণ আছে ৭৫ লাখ। খাবারের দোকানে বাকি আছে ৭০-৭৫ লাখ টাকা। রিমালের আঘাতে খামারের ওপর ৫-৬ হাত পানি উঠে মাছ ভেসে গেছে। কয়েক দিনের মধ্যে তিনি মাছ বিক্রি করতে পারতেন। এই ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর প্রায় ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

সার–বীজ ও নগদ টাকা দিয়ে কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়া হয়। তেমনি ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের প্রণোদনা হিসেবে পাঙাশ-তেলাপিয়ার পোনা দেওয়া প্রয়োজন। তাঁদের জন্য ব্যাংকঋণের ব্যবস্থাও করতে হবে।
নুরুল ইসলাম, সভাপতি, ভোলা ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী ও জেলে সমিতি

চরফ্যাশন উপজেলার মুজিবনগর, চর কুকরি-মুকরি ও ঢালচরের ঘের–পুকুর প্লাবিত হয়েছে। সেখানকার খামারিরা জানান, তাঁদের তিনটি ইউনিয়নে ৩৫০টি পুকুর ডুবে মাছ ভেসে গেছে। খামারিদের অন্তত দুই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

ভোলার ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী ও জেলে সমিতির সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের কারণে ভোলার মৎস্য খামারিরা বারবার ঝড়ঝঞ্ঝা, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কিন্তু সরকার ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের সহায়তা দেয় না। এমনকি ব্যাংকঋণও পাওয়া যায় না। খামারিদের জন্য বরাদ্দকৃত ঋণ পাচ্ছেন ঠিকাদার। কারণ, সেখানে ঝুঁকি কম। খামারিদের বেসরকারি সংস্থা, মহাজনের কাছ থেকে বেশি সুদে ঋণ নিতে হয়। দোকান থেকে বাকিতে বেশি দামে মাছের খাবার কিনতে হয়।

নুরুল ইসলাম আরও বলেন, সার–বীজ ও নগদ টাকা দিয়ে কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়া হয়। তেমনি ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের প্রণোদনা হিসেবে পাঙাশ-তেলাপিয়ার পোনা দেওয়া প্রয়োজন। তাঁদের জন্য ব্যাংকঋণের ব্যবস্থাও করতে হবে।

এ বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য খামারিদের তালিকা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এবং সরাসরি ঢাকায় মৎস্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আমরাও চাই ক্ষতিগ্রস্ত খামারিরা ক্ষতিপূরণ পাক।’