পড়াশোনা শেষে তাঁরা ফিরেছেন গ্রামে, কাজ করছেন পরিবেশ–প্রকৃতি রক্ষায়
চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন গ্রাম থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য শহরে ছুটে গিয়েছিলেন একদল তরুণ। কিন্তু নগরজীবনের চাকচিক্য ধরে রাখতে পারেনি তাঁদের। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে তাঁরা ফিরে আসেন গ্রামে, প্রকৃতির মাঝে। পরিবেশ রক্ষায় তাঁদের কেউ লাগাচ্ছেন পরিবেশবান্ধব হাজারো গাছ, কেউ আহত বন্য প্রাণীদের সেবা দিচ্ছেন, কেউবা রুখছেন বন্য প্রাণীর শিকার। এভাবেই তাঁরা একেকজন হয়ে উঠছেন সবুজ প্রকৃতি ও বন্য প্রাণীর বন্ধু।
বন্য প্রাণীর বন্ধু বখতিয়ার
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার গাইদঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বখতিয়ার হামিদ ওরফে বিপুল। শিক্ষকতা পেশায় যেমন রয়েছে তাঁর সুনাম, তেমনি বন্য প্রাণীর বন্ধু হিসেবে দেশজুড়ে ছড়িয়েছে তাঁর খ্যাতি। এক যুগের বেশি সময় ধরে তিনি বন্য প্রাণীর বন্ধু হিসেবে সেবা দিয়ে চলেছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ইতিমধ্যে পেয়েছেন ভিএসও-প্রথম আলো স্বেচ্ছাসেবা সম্মাননা-২০১৯সহ বিভিন্ন পদক।
বখতিয়ার এলাকার তরুণদের সংগঠিত করে নিজ গ্রাম চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার বেলগাছি গ্রামে গড়ে তুলেছেন পরিবেশবাদী সংগঠন ‘পানকৌড়ি’। পানকৌড়ির সদস্যরা নিজ গ্রাম ছাড়াও আশপাশের গ্রামে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল সংরক্ষণ, আহত বন্য প্রাণী উদ্ধার, চিকিৎসা ও উপযুক্ত পরিবেশে অবমুক্তকরণ এবং বিপন্ন প্রজাতির পশুপাখি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসছেন। এসব বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে স্থিরচিত্র ও ভিডিও চিত্র ধারণ করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গ্রামগঞ্জের মোড়ে, হাটবাজারে, জনসমাগম এলাকায় মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে পরিবেশ ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ, প্রাণীর প্রতি সদাচরণ এবং প্লাস্টিক ও শব্দদূষণ প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে প্রচারাভিযান চালাচ্ছেন। তাঁরা উঠান বৈঠক, মাইকিং, দেয়ালচিত্র, পোস্টার ও প্রচারপত্র বিলি করছেন।
বখতিয়ার ও তাঁর সারথিদের কারণে বেলগাছি গ্রামটি আর দশটি গ্রামের চেয়ে একটু ভিন্নতা পেয়েছে। জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ গ্রামটিতে বন্য প্রাণী শিয়াল, খাটাশ, মেছো বিড়াল, বনবিড়াল, খরগোশের উপস্থিতি স্বাভাবিক ঘটনা। এ ছাড়া দুর্লভ প্রজাতির পাখি মেটে তিতির, জার্ডন লিফবার্ড, হলদে চোখ ছাতারে, ছোট ছাতারের দেখা মিলবে সচরাচর। গ্রামটিতে সরালি, জলময়ূর, পানকৌড়ি, ঘুঘু, বাবুই, শামুকখোল, ডাহুক, হরিয়াল ও বকের সারি দেখে নয়ন জুড়িয়ে যাবে। এ ছাড়া গ্রামটিতে প্রায়ই দেখা যায়, বিরল প্রজাতির সাপ।
বখতিয়ার বলেন, ‘মা–বাবা, ছোট ভাই, স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের আট সদস্যের সবাই বন্য প্রাণী নিয়ে কাজ করছেন। আমার বয়স যখন ৭-৮ বছর, সে সময়ে একটা পোষা বিড়াল আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল; বিড়ালটাকে আমি খুব আদর করতাম। যেখানে কবর দেওয়া হয়েছিল, প্রায় প্রতিদিনই তার পাশে বসে কাঁদতাম। পরে গ্রামের বকচর বিলে এক শিকারি এসে এয়ার বন্দুক দিয়ে বক শিকার করে। চোখের সামনে বকের লুটিয়ে পড়া দেখে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। প্রতিবাদ করায় সেবার লাঞ্ছনারও শিকার হয়েছি।’ সেই ঘটনার পর তিনি ভাবলেন, আগে নিজের এলাকা নিরাপদ করতে হবে। পরে তরুণদের সংগঠিত করতে গড়ে তুলেছেন ‘পানকৌড়ি’ নামের সংগঠন। পানকৌড়ির সভাপতি তিনি আর সদস্য আছেন ৫০ জন।
বৃক্ষপ্রেমী শাহিন সরকার
সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের ৬২ নম্বর আড়িয়া গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা শাহিন সরকার ২০১৮ সালে স্থানীয় কিশোর-তরুণ ও যুবদের নিয়ে গড়ে তোলেন পরিবেশবাদী সংগঠন ‘মানবতার জন্য’। এর সদস্যরা সাত বছর ধরে বৃক্ষরোপণ ও বন্য প্রাণী রক্ষার মধ্য দিয়ে পরিবেশ রক্ষার বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন চারদিকে। মাত্র ১০ জন নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমান সদস্যসংখ্যা ১৫০। যাঁদের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। শাহিন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। শাহিন বলেন, শুরুর দিকে গ্রামবাসীর অনেকেই বিরোধিতা করলেও বন্য প্রাণী ও পরিবেশ রক্ষায় বর্তমানে পুরো গ্রামবাসী এখন এককাতারে।
৬২ নম্বর আড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মস্তাক আহম্মেদ সরকার ও গৃহিণী সুজলা বেগমের দুই সন্তানর মধ্যে শাহিন সরকার ছোট। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাসের পর চাকরির পেছনে ঘোরেননি। পৈতৃক জমিতে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
শাহিন সরকার জানান, মা–বাবার প্রেরণা ও সাধারণ মানুষের সমর্থনে এত দূর এসেছেন। তিনি বলেন, ‘শৈশবেই দেখেছি বন্য প্রাণীর প্রতি বাবা কতটা দয়াশীল। তিনি বাড়ির আঙিনা, পুকুরপাড় ও পতিত জমিতে তালসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগাতেন। বলতেন, এসব গাছে পাখিরা বাসা বাঁধবে, গাছের ফল খাবে, তাতে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জন করব, প্রকৃতিও ভালো থাকবে, আমরাও বেঁচে থাকার অক্সিজেন পাব।’
শাহিন বলেন, সংগঠনের সদস্যদের বেশির ভাগই ছাত্র ও বেকার। কারও টিফিনের বাঁচানো টাকা, কারও হাতখরচের টাকা, আবার কোনো প্রবাসী বা চাকরিজীবীর দেওয়া টাকায় আমাদের সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি। আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, আমাদের দক্ষিণ–পশ্চিম অঞ্চলের পাঁচটি জেলাকে আগে বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য গড়ে তোলা। এরপর তা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া। তাতে তরুণেরা ভালো কাজে সম্পৃক্ত হবে। এলাকায় অপরাধপ্রবণতা কমে যাবে।
সম্প্রতি গ্রামটিতে বসে কথা হয় মানবতার জন্যর কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে। তাঁরা জানালেন, গ্রামের রাস্তার দুই পাশে বেড়ে ওঠা কৃষ্ণচূড়া ও তালগাছগুলো ২০১৮ সালে তাঁরা লাগিয়েছিলেন। ক্লান্ত পথিক যেমন এসব গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেন, তেমনি পাখপাখালির দল গড়ে তুলেছে একের পর এক আবাসস্থল-বাসা। গ্রামের কবরস্থান, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ রাস্তার দুই ধারে বিভিন্ন প্রজাতির ফল, ফুল ও ঔষধি গাছের পাশাপাশি ১৫ কিলোমিটার রাস্তার দুই ধারে অন্তত ২০ হাজার তালবীজ রোপণ করেছেন। নিয়মিত পরিচর্যায় তালগাছের চারাগুলো মাথা উঁচু করে অবস্থান জানান দিচ্ছে। প্রতি শুক্রবার মসজিদে জুমার নামাজের পর পরিবেশ রক্ষায় প্রচারপত্র বিলি, অন্যান্য দিন হাটবাজারে মানবতার জন্যর সদস্যরা প্রচারপত্র বিলি ও মাইকিং করে থাকেন। রাসায়নিক সার ও বালাইনাশকের পরিবর্তে জৈব সার ও বালাইনাশক ব্যবহারে কৃষকদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা, প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। ব্যবহারের পর কীটনাশকের বোতল ও প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলার জন্য মাঠে মাঠে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বস্তা। যেখানে লেখা হয়েছে ‘কীটনাশক বর্জ্য এখানে ফেলুন’। এক বছর ধরে তাঁরা প্লাস্টিক বর্জ্যের বিনিময়ে গাছের চারা বিতরণ এবং তা লাগিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি পরিচর্যা করে আসছেন।
পরিবেশ সুরক্ষায় আহসানের পথচলা
সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের বড়শলুয়া নিউমডেল কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক আহসান হাবীব। তিনি ‘বাংলাদেশ ওয়াইল্ডলাইফ অ্যান্ড নেচার ইনিশিয়েটিভ’ নামের পরিবেশবাদী সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বেচ্ছায় সেবা দিয়ে চলেছেন। শুরুর দিকে মানবতার জন্যর হয়ে কাজ করলেও চলতি বছরের ২৬ মার্চ থেকে নতুন উদ্যমে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ এলাকার তরুণদের নিয়ে শুরু করেছেন পথচলা। তাঁর কাজের মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিতকরণ, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ, কীটনাশক ব্যবহার সীমিতকরণ, বন্য প্রাণীর আবাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা, আহত বন্য প্রাণীর সুচিকিৎসা নিশ্চিতকরণ, অনাবাদি ও খাসজমিতে বৃক্ষরোপণ এবং জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা বাস্তবায়ন অনুসরণে ভূমিকা রাখা। সেই সঙ্গে এসব বাস্তবায়নে করছেন প্রচার-প্রচারণা।
আহসান হাবীব বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গার প্রত্যন্ত অঞ্চলে শুরু হওয়া পরিবেশ রক্ষার এই আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে চাই।’
যশোর অঞ্চলের সাবেক বন রক্ষক মোল্ল্যা রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বখতিয়ার হামিদ, শাহিন সরকার ও আহসান হাবিবের মতো পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষায় সব মানুষের এগিয়ে আসা দরকার। না হলে আমাদের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে, প্রকৃতি ও পরিবেশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে।’