গাজীপুরের ঐতিহ্য ৪০০ টাকা কেজির ‘ধনীর চিড়া’

গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ধনীর চিড়া প্রতি কেজি ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়। কালিয়াকৈর বাসস্ট্যান্ড এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

বাজারে সাধারণ চিড়ার দাম প্রতি কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকা। আর গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ‘ধনীর চিড়া’ প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৪০০ টাকায়। কখনো কখনো ৫০০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হয়।

কালিয়াকৈর উপজেলার সূত্রাপুর ইউনিয়নের বারবাড়িয়া গ্রামের দুর্লভ সরকারের স্ত্রী ধনী রানী সরকার প্রথম এই চিড়া করেন। তাঁর নামেই চিড়ার নাম হয় ‘ধনীর চিড়া’।

স্থানীয় বাসিন্দা যতীন্দ্র সরকার বলেন, বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় ধনীর স্বামী দুর্লভ সরকার মারা যান। রেখে যান দুই সন্তান। উপায় না দেখে তিনি সাহায্যের জন্য চলে যান বলিয়াদী জমিদারবাড়িতে। তখন সেখান থেকে তাঁকে কিছু ধান দেওয়া হয়েছিল। তিনি চিন্তা করলেন, ধান থেকে ভাত রান্না করে খেলে কিছুদিনের মধ্যে তা শেষ হয়ে যাবে। দীর্ঘদিন খাওয়ার আশায় ঢেঁকিতে চিড়া কোটেন তিনি। চিড়ার স্বাদে মুগ্ধ ধনী চিন্তা করেন, সব ধানের চিড়া না কুটে কিছু ধান বীজ হিসেবে বপন করার। তিনি নিজে ধান বোনেন। প্রতিবেশীদেরও কিছু ধানের বীজ দেন। এভাবে পুরো এলাকায় এই ধানের জাত ছড়িয়ে পড়ে।

কালিয়াকৈর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পলাশ মিষ্টান্ন ভান্ডারসহ কয়েকটি দোকানে বিক্রি করা হয় ধনীর চিড়া। খেতে সুস্বাদু হওয়ায় চাহিদাও অনেক। দাম অনেক চড়া হওয়ার পরও ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকে।

ধনীর চিড়ার ক্রেতা আরিফুল ইসলাম বলেন, অনেক দিন ধরে তাঁর স্ত্রী ধনীর চিড়া কিনে নিয়ে যেতে বলছেন। সময়ের অভাবে কেনা হয়নি। সময় পেয়ে ২০০ টাকা দিয়ে আধা কেজি ধনীর চিড়া কিনে বাড়ি যাচ্ছেন তিনি।

চাপাইর এলাকার ক্রেতা জেসমিন আক্তার বলেন, ‘ধনীর চিড়া নাকের কাছে ধরে ঘ্রাণ নিলেই খেয়ে দেখতে ইচ্ছা করবে। আমি প্রায়ই বাড়ির জন্য কিনে নিয়ে যাই। ছেলে-মেয়েরা গুড় বা চিনি দিয়ে এই চিড়া খেতে খুব পছন্দ করে।’

কালিয়াকৈর বাসস্ট্যান্ড এলাকার পলাশ মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিক গোবিন্দ ঘোষ বলেন, বাজারে সাধারণ চিড়ার দাম ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি। ধনীর চিড়া ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও দূরদূরান্ত থেকে মানুষ চিড়া নিয়ে যাচ্ছেন। অল্প কয়েকটি পরিবার এই চিড়া তৈরি করায় চাহিদামতো চিড়ার জোগান দিতে পারেন না তাঁরা।

গাজীপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বই থেকে জানা গেছে, ১৮৮৬ সালের দিকে রানি ভিক্টোরিয়ার জন্মদিনে ঢাকার তৎকালীন গভর্নর উপঢৌকন হিসেবে কয়েক মণ ধনীর চিড়া পাঠান। এর গুণ, মান ও স্বাদের প্রশংসা করেন অনেকে। ধনীকে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে ভয়ে ধনী যাননি। ১৮৮৭ সালে ব্রিটেনের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি হিসেবে ধনী রানী গয়া, কাশী ও বৃন্দাবনসহ ভারতের তীর্থস্থান সফর করেন।

ধনীর চিড়া প্রস্তুতকারী বারবারিয়া গ্রামের যতীন্দ্র সরকার বলেন, ‘আমাদের গ্রামে আমি ও ধীরেন্দ্র দুজন ধনীর চিড়া বানাই। বর্তমানে ধীরেন্দ্র খুব একটা বানান না। এ ছাড়া যে নয়াশাইল ধান দিয়ে এই চিড়া তৈরি করা হয়, সেই ধান এখন খুব একটা পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায়, তার দামও অনেক বেশি। তাই চাহিদা থাকলেও প্রয়োজনমতো চিড়া বানানো যায় না।’

কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই ধনীর চিড়া খেতে খুবই সুস্বাদু। দাম বেশি হলেও এর বেশ চাহিদা। এই চিড়ার উৎপাদন বাড়াতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।