৪০ কিলোমিটারে ৪৭টি লেভেল ক্রসিংই অবৈধ

ট্রেন আসায় সড়কে দাঁড়িয়ে অটোরিকশাসহ বিভিন্ন ছোট যানবাহন। ঝুঁকি নিয়ে এভাবে প্রতিদিন অবৈধ লেভেল ক্রসিং পার হয়ে যানবাহন চলাচল করছে। গতকাল সকালে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের পটিয়ার দক্ষিণ ভূর্ষি - কেলিশহর সড়কে মাতৃভাণ্ডার এলাকায়প্রথম আলো

রেললাইনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে একটি সড়ক। ট্রেনের হুইসেল শোনা গেলেও সেই সড়কের ওপর দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই চলাচল করছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ইজিবাইক, মোটরসাইকেলসহ নানা ধরনের যানবাহন। ট্রেন যখন সড়কের একেবারে কাছাকাছি, তখন রেলপথ থেকে সরে যাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু হয় যানবাহনের চালকদের। ৪ ডিসেম্বর বেলা তিনটার দিকে এমনই চিত্র চোখে পড়ে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেলপথের পটিয়া পৌরসভার মাতৃভান্ডার এলাকায়।

রেলপথের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সড়কটি নির্মাণ করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। অনুমতি না নেওয়ায় রেল কর্তৃপক্ষের কাছে এটি পরিচিত অবৈধ লেভেল ক্রসিং হিসেবে। ফলে লেভেল ক্রসিংটিতে যান নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো ব্যারিয়ার (প্রতিবন্ধক) বসানো হয়নি, নেই রেল কর্তৃপক্ষের কোনো গেটম্যান।

পটিয়ার মাতৃভান্ডারের এই এলাকাটির মতো চট্টগ্রাম নগরের ষোলোশহর থেকে চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার রেলপথে অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে ৪৭ টি। এর মধ্যে বেশির ভাগ এলাকায় রেলপথের ওপর দিয়ে পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। কিছু স্থানে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে নির্মাণ করা কাঁচারাস্তাও রয়েছে। এসব অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে গেটম্যান ও প্রতিবন্ধক না থাকায় যেকোনো সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।

এই রেলপথে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকে ট্রেন চলাচল অনেকটাই বন্ধ ছিল। তবে সম্প্রতি রেলপথটি দিয়ে কক্সবাজারে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। পর্যটনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই রেলপথে ট্রেন চলাচল পুরোদমে শুরু হওয়ার পর থেকে অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথে বৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে ২৫ টি। এসব লেভেল ক্রসিংয়ে প্রতিবন্ধক ও গেটম্যান রয়েছে। তবে ৪৭টি অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের কোনোটিতেই গেটম্যান নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা ট্রেন অতিক্রমের সময় যে যার মতো সতর্কতা অবলম্বন করে এসব লেভেলে ক্রসিং পার হন। রেল কর্মকর্তাদের দাবি, অবৈধ হওয়ায় এসব লেভেল ক্রসিং বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা। সম্প্রতি কিছু অবৈধ লেভেল ক্রসিং বন্ধে ইস্পাতের খুঁটি গেঁড়ে দেওয়া হয়েছে।

সাইকেল নিয়ে অবৈধ লেভেল ক্রসিং পার হচ্ছেন এক ব্যক্তি। ৩ ডিসেম্বর সকালে পটিয়ার বাহুলী সড়ক
ছবি- প্রথম আলো

মাতৃভান্ডার এলাকায় রেলপথের ওপর দিয়ে নির্মিত পিচঢালাই করা সড়কটির ওপর দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন অন্তত ১০টি গ্রামের মানুষ। সড়কটি দিয়ে কেলিশহর, দক্ষিণ ভূষ্যি, কেচিয়া পাড়া, রতনপুরসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ উপজেলা সদরে যান।

মাতৃভান্ডার এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ট্রেন কাছাকাছি এলেও অনেকেই তড়িঘড়ি করে পার হওয়ার চেষ্টা করেন। এতে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই রেল কর্তৃপক্ষের উচিত গুরুত্বপূর্ণ সড়কটির লেভেল ক্রসিংটিতে দ্রুত ব্যারিয়ার বসিয়ে গেটম্যান নিয়োগ দেওয়া।

সরেজমিনে চন্দনাইশ উপজেলার কাঞ্চনাবাদ ইউনিয়নের মুরাদাবাদ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও রেলপথের ওপর নির্মিত হয়েছে মুজাফফরবাদ-মুরাদাবাদ পাকা সড়ক। এই ‘অবৈধ’ লেভেল ক্রসিংয়েও প্রতিবন্ধক বসানো হয়নি, নেই কোনো গেটম্যান। সড়কটিতে যান চলাচল স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে দুই প্রান্তে কয়েকটি ইস্পাতের খুঁটি গেড়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও ইস্পাতের খুঁটির মাঝখানের ফাঁকা জায়গা দিয়েই অনায়াসে চলাচল করছে সিএনজি অটোরিকশাসহ ছোট আকারের যানবাহন।

চন্দনাইশের রওশন হাটের উত্তর বটতল এলাকা এবং পটিয়ার ডেঙ্গাপাড়া এলাকায়ও কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছাড়াই রেললাইনের ওপর স্থাপন করা সড়কে যান চলাচল করতে দেখা গেছে।

চন্দনাইশের কাঞ্চনাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস শুক্কুর প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর এলাকায় রেললাইনের ওপর দিয়ে এলজিইডির পাঁচটি সড়ক রয়েছে। সব সড়কই গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ ও যানবাহন চলাচল করে। অবৈধ অজুহাতে এসব সড়ক বন্ধ করে দেওয়া যৌক্তিক নয়।

আবদুস শুক্কুর বলেন, রেললাইনের কাছাকাছি স্থানে পাঁচটি সড়কের ৬ থেকে ৭ ফুট ফাঁকা রেখে বাকি অংশে ইস্পাতের খুঁটি গেড়ে দেওয়া হয়েছে। এতে বড় আকারের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকলেও ছোট যানবাহন চলাচল করতে সমস্যা হচ্ছে না। তবে কোনোভাবেই সড়ক পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না। প্রয়োজনে রেল কর্তৃপক্ষকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে হবে।

জানতে চাইলে রেল পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় প্রকৌশলী আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথের বৈধ সব লেভেল ক্রসিংয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু সড়ক বন্ধ করা হলেও চালকেরা ইস্পাতের পাত তুলে নিয়ে যানবাহন চালাচ্ছেন। এতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আপাতত অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে গেটম্যান নিয়োগ ও প্রতিবন্ধকতা স্থাপনের পরিকল্পনা নেই।