হঠাৎ আলোচনায় আসা বিএসপির সাইফুদ্দীনের এত কম ভোট!

সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমেদ মাইজভান্ডারী।

দল নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাওয়ার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় আসেন বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমেদ মাইজভান্ডারী। চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসন আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিতে পারে গুঞ্জনও ছিল। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। নির্বাচনেও লড়েছেন সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমেদ (একতারা)। ভোট পেয়েছেন মাত্র ৩ হাজার ১৫১ ভোট। তিনি হয়েছেন তৃতীয়।

এই আসনে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী খাদিজাতুল আনোয়ার পেয়েছেন ১ লাখ ৬৮৫ ভোট। আর আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র হোসাইন মোহাম্মদ আবু তৈয়ব (তরমুজ) ৩৬ হাজার ৫৬৬ ভোট পেয়েছেন। সাইফুদ্দীন আহমদ তৃতীয় হলেও ভোটের পরিমাণ খুব কম। তিনি জামানত হারাচ্ছেন।

শুরুর দিকে প্রচারণায় সমানতালে তিনজনই মাঠে ছিলেন। নির্বাচনের ১০ দিন আগে হঠাৎ করে খাদিজাতুলকে সরে যেতে বলেন কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের চাপে তিনি সরে যাননি। পরে কেন্দ্র থেকে বলা হয়, ভোটে মাঠে থাকবে দুজনই। যিনি জয়ী হয়ে আসেন। শেষ পর্যন্ত গতকাল রোববার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এক লাখের বেশি ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন খাদিজাতুল আনোয়ার।

খাদিজাতুল, তৈয়ব ও সাইফুদ্দীন ছাড়াও এই আসনে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের মোহাম্মদ শফিউল আজম চৌধুরী, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের চেয়ার প্রতীকের প্রার্থী মীর মোহাম্মদ ফেরদৌস আলম, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মোমবাতি প্রতীকের মোহাম্মদ হামিদ উল্লাহ ও ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ শাহজাহান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মোট ভোটার রয়েছেন ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৭ জন। এর মধ্যে ভোট গ্রহণ হয় ১ লাখ ৪৯ হাজার ৪৬৫টি। বাতিল হয় ৩ হাজার ৯৪৫টি। বৈধ ভোটের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৫২০টি। বাতিল ভোটের চেয়ে কম ভোট সাইফুদ্দীনের।

গতকাল সারা দিন ফটিকছড়ি উপজেলা সদর, নানুপুর, বিবির হাট, ভুজপুর, শান্তিরহাট, নারায়ণহাট, বাগান বাজারসহ বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ঘুরে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোটাররা প্রথমত দলীয় প্রতীক নৌকা ও দ্বিতীয়ত খাদিজাতুলের বাবা প্রয়াত সংসদ সদস্য (১৯৯৬ ও ২০০১) রফিকুল আনোয়ারের বিষয়টি মাথায় রেখেছেন। ১১ বছর আগে মারা গেলেও উন্নয়নসহ মানুষের কাছাকাছি থাকার জন্য রফিকুল আনোয়ারের কথা স্মরণে রাখেন বেশির ভাগ বাসিন্দা।  

এ ছাড়া টানা দুই মেয়াদে তাঁরা নৌকায় ভোট দিয়ে বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীকে নির্বাচিত করেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব রয়েছে। তাই এবার নিজেদের প্রার্থী পাওয়ায় দলীয় নেতা-কর্মীর বেশির ভাগ খাদিজাতুলের জন্য মাঠে নামেন।

উপজেলার জুজখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে গত রোববার দুপুরে আওয়ামী লীগের সমর্থক নেজামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিগত নির্বাচনের চেয়ে এবার নেতা-কর্মীরা দ্বিগুণ উৎসাহে নৌকার প্রার্থীর জন্য কাজ করেছেন। এত বছর দল ক্ষমতায় থাকার পরও নিজ দলের এমপি না পাওয়ায় দুঃখ আছে।

নেজামের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী ফাতেমা আক্তার বলেন, খাদিজাতুল যেভাবে সবার সঙ্গে মিশে গেছেন, সেভাবে কেউ মেশেনি। ভোট চাওয়ার সময় কেঁদেছেন পর্যন্ত। তাঁকে না দিলে কাকে দেব। একই কথা বলেন, পার্শ্ববর্তী চা-দোকানে বসা নুর আলীরও।

খাদিজাতুল আনোয়ার জয়ী হওয়ার প্রসঙ্গে তাঁর প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারী ও ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন মুহুরী আজ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তৃণমূল পর্যায়ের সবার দীর্ঘদিনের চাওয়া ছিল নৌকা প্রতীকে দলের লোক যাতে এমপি প্রার্থী হয়। এবার পেয়ে সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে ওঠে, যার ফলে যে যার অবস্থান থেকে কাজ করেছে। মানুষকে বুঝিয়েছে। সেই ফল আমরা পেয়েছি।’

সৈয়দ সাইফুদ্দীনের হেরে যাওয়ার কারণের মধ্যে আরেকটি কর্মীর অভাব। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের তুলনায় বিএসপির সাংগঠনিক ভিত্তি ছিল দুর্বল। আবার অনেক সাধারণ মানুষ চাননি তাঁদের শ্রদ্ধার পাত্র মাইজভান্ডার দরবার থেকে কেউ রাজনীতির মাঠে আসুক। ভদ্র, পরিচ্ছন্ন মানুষ হিসেবে সৈয়দ সাইফুদ্দীনকে ব্যক্তিগতভাবে অনেকে পছন্দ করেন। কিন্তু ভোটের মাঠে মানতে নারাজ তাঁরা। এ ছাড়া গতবারের সংসদ সদস্য সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী সৈয়দ সাইফুদ্দীনকে সমর্থন না দিয়ে নৌকাকে সমর্থন দেন। ৪ জানুয়ারি নজিবুল নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে। নজিবুলের ভাতিজা সাইফুদ্দীন।  

কম ভোট পাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে বিএসপির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমেদকে আজ একাধিকবার কল করা হলেও তিনি না ধরায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অবশ্য গত রোববার সকালে ফটিকছড়িতে ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনের সময় তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, সুষ্ঠু ভোট হচ্ছে। পরে দুপুরের দিকে তিনি কয়েকটি কেন্দ্রে জাল ভোট হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছিলেন।

নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে আজ বিকেলে কথা হয় বিএসপির দপ্তর সম্পাদক শাহ মুহাম্মদ ইব্রাহিম মিয়ার সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। তবে কিছু লোক আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।’

স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত ১১টি জাতীয় নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগ পাঁচবার, বিএনপি তিনবার, জাতীয় পার্টি একবার জিতেছিল। এর মধ্যে সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে দুইবারসহ চারবার নির্বাচিত হয়েছিলেন।