মৃণাল-ফয়সালের দ্বন্দ্বে আতঙ্ক

প্রতীক বরাদ্দের পর সংঘর্ষ, গুলি, হুমকি, দলীয় কার্যালয় ভাঙচুরসহ দুই পক্ষের মধ্যে অন্তত ১০টি ঘটনা ঘটেছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মুন্সিগঞ্জ-৩ (সদর ও গজারিয়া) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাশ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সালের মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর সংঘর্ষ, গুলি, হুমকি, দলীয় কার্যালয় ভাঙচুরসহ দুই পক্ষের মধ্যকার অন্তত ১০টি ঘটনা ঘটেছে। এতে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে নির্বাচনী মাঠ। এর ফলে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে স্থানীয় নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে।

এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান দলের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাশ এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মহিউদ্দিনের ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মোহাম্মদ ফয়সাল। দল বেছে নেয় টানা দুইবারের সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তিকে। এরপর মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার দুইবারের মেয়র ফয়সাল স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। তিনি পেয়েছেন কাঁচি প্রতীক।

খোঁজ নিয়ে ও স্থানীয় নেতা–কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১১ সালের পৌর নির্বাচনে মৃণাল কান্তি দাশ ফয়সালের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। এরপর থেকে তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। নেতা-কর্মীরা দুভাগে বিভক্ত হতে থাকেন। এ সময়ের মধ্যে দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে একাধিক সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। একে অপরকে আক্রমণ করে কথা বলেন দুই নেতা। জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই এই দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করছে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মুন্সিগঞ্জ সদর ও গজারিয়া সার্কেল) থান্দার খাইরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন ঘিরে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পুলিশ প্রশাসন বদ্ধপরিকর। পুলিশ সুপারের নির্দেশে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে প্রতিটি ইউনিয়নে বিটপুলিশের সদস্যরা অবস্থান করছেন। নির্বাচন পর্যন্ত এ অবস্থা থাকবে। কেউ পরিস্থিতি অস্বাভাবিক করতে চাইলে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের দিন থেকে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে মৃণাল কান্তি ও ফয়সালের মধ্যকার। ওই দিন গজারিয়া উপজেলায় তাঁদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে নৌকার দুই সমর্থকসহ সাতজন আহত হন। পরদিন মঙ্গলবার সদর উপজেলার আধারায় নৌকার প্রচার ক্যাম্প ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে কাঁচির সমর্থকদের বিরুদ্ধে। একই দিন গজারিয়া কাঁচি প্রতীকের প্রচারমাইক ভাঙচুর ও দুই সমর্থককে মারধর করা হয়। এরপর গত বৃহস্পতিবার পোস্টার লাগানোকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে আবারও সংঘর্ষ হয়।

এ সময় সামাদ মোল্লা নামের নৌকা প্রতীকের এক কর্মীকে কুপিয়ে জখম করা হয়। আহত হন বাদশা নামে কাঁচির এক সমর্থক। পরের দিন বিকেলে সদরে মহাকালী এলাকায় সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক ও কাঁচির সমর্থক পিন্টু খানকে পেটায় নৌকার সমর্থকেরা। এদিন রাতে উপজেলার মোল্লাকান্দি ইউনিয়নের আনন্দপুর গ্রামে কাঁচির সমর্থক হেবা মোল্লা নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে হুমকি ও গুলি করেন নৌকার লোকজন।

এ ছাড়া গত শনিবার সকালে সদরের গুহেরকান্দি এলাকায় ওমর ফারুক হাওলাদার নামের নৌকার সমর্থককে মারধর এবং বিকেলে গজারিয়া উপজেলায় দলীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর করা হয়। পরদিন রাতে মোল্লাকান্দিতে নৌকার ক্যাম্প ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে কাঁচি প্রতীকের সমর্থকদের বিরুদ্ধে। সব৴শেষ গত বুধবার দুপুরে একই ইউনিয়নের মুন্সিকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৌকার নির্বাচনী ক্যাম্প করাকে কেন্দ্র করে দুপক্ষের সমর্থকদের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে রাসেল মোল্লা নামের কাঁচি প্রতীকের এক সমর্থককে পিটিয়ে মাথা ফাটানো হয়।

এসব ঘটনায় মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনের নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির কাছে দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে চারটি করে আটটি অভিযোগ জমা পড়ে। কয়েক দিনের ঘটনায় গজারিয়া থানায় মৃণাল কান্তি দাশের সমর্থকদের বিরুদ্ধে একটি এবং মুন্সিগঞ্জ সদর থানায় দুই পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা করেছে।

আওয়ামী লীগের অন্তত ১০-১২ নেতা–কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুন্সিগঞ্জের তিনটি সংসদীয় আসনের মধ্যে মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনটি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ফয়সাল ও মৃণাল কান্তি দুজনই শক্তিশালী প্রার্থী। নির্বাচনে থাকা ও জয়ী হওয়ার ব্যাপারে দুই প্রার্থী মরিয়া। কেউ কাউকে ছাড় দেবে না। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।

নৌকার প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাশের মুঠোফোনে কল করা হলে পরে কথা বলবেন বলে রেখে দেন। পরে কল করা হলে ধরেননি। স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সালের দাবি, নির্বাচনে তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখে মৃণাল কান্তি দাশ ও তাঁর সমর্থকেরা ভয়ে আছেন। এ জন্য প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে নৌকার সমর্থকেরা কাঁচির সমর্থকদের মারধর, বাড়িতে গুলি ও হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। নির্বাচনী ক্যাম্প, দলীয় কার্যালয় ভাঙছে। এতে পরিস্থিতি কিছুটা ঘোলাটে হলেও এখনো সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে। প্রশাসন এখনো নিরপেক্ষভাবে এসব বিষয় দেখছে।

দুই পক্ষের ঝামেলা অব্যাহত থাকলে বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা নিয়ে ফয়সাল বলেন, ‘আমরা শান্তির পক্ষে নৌকার প্রার্থী ও তাঁদের লোকজন আমাদের ওপর হামলা করলেও আমরা সহ্য করে যাব। ইতিমধ্যে আমাদের সমর্থক সবাইকে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

মুন্সিগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সহসভাপতি শহীদ-ই-হাসান প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কেন্দ্র করে এ আসনের ইতিমধ্যেই কয়েকটি সহিংস ঘটনা ঘটে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বড় ধরনের ঘটনা ঘটে যেতে পারে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের নিয়ে প্রশাসনের বসা এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।