শহিদুল ইসলামের মমতার স্কুল
পড়াশোনায় পিছিয়ে ছিল বিদ্যালয়টি। ভবনও ছিল পড়ো পড়ো। এমন ভগ্নদশায় শিক্ষার্থীরাও একে একে বিদ্যালয় ছেড়ে যাচ্ছিল। সবাই যখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল, তখন হাল ধরেন একজন। বছর তিনেকের মাথায় ঘুরে দাঁড়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। শতভাগ পাস তো আছেই, সঙ্গে যোগ হয় নতুন কিছু উদ্যোগ। এনে দেয় দেশজোড়া খ্যাতি।
সৎ ও আদর্শবান শিক্ষার্থী গড়ে তুলতে ‘সততা স্টোর’, শিক্ষার্থী ঝরে পড়া ঠেকাতে ‘বন্ধু টিম’–এর মতো উদ্যোগ নিয়ে রীতিমতো সাড়া ফেলে দেয় স্কুলটি। তলানি থেকে এভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে আছে এক শিক্ষকের অসামান্য অবদান। যিনি দিনরাত অক্লান্ত খেটে চলেছেন। সকালে স্কুলে আসেন, বের হন সেই রাতে। শুধু কি অক্লান্ত শ্রম! বিদ্যালয়ের উন্নয়নে নিজের বেতনের টাকাও নির্দ্বিধায় খরচ করেন।
তিনি মো. শহিদুল ইসলাম (৫৩)। রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। বিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের যেন পরম মমতায় আগলে রেখেছেন তিনি।
হাল ধরেন শহিদুল
১৯৬৮ সালে বালিয়াকান্দির তৎকালীন ইসলামপুর ইউপির চেয়ারম্যান আবদুল গফুর মোল্লা নিজের ৩৩ শতক জমিতে একটি টিনের ছাপরা করেন। ২০ শিক্ষার্থী ও চারজন শিক্ষক নিয়ে বিদ্যালয়টি চালু হয়। কিন্তু ফলাফল তেমন ভালো হতো না। ১৯৮৪ সালে জাতীয়করণের পরও পিছিয়েই ছিল বিদ্যালয়টি।
২০০৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোলে স্নাতকোত্তর পাস শহিদুল ইসলাম। তখন শিক্ষার্থী ছিল ১২৫ জন। যোগদানের পর পড়াশোনার দুর্দশা দেখে হতাশ হন। শুরুর কয়েক বছর মাঝেমধ্যে ছুটি কাটাতেন। কিন্তু ১৫ বছর ধরে এক দিনও ছুটি নেননি। নিজের মেধা, শ্রম সবই দিয়েছেন স্কুলের পেছনে। ওই বছর বিদ্যালয়ে পাসের হার দাঁড়ায় ৬৫ শতাংশ। পরের বছর ৮৫ শতাংশ। তারপর পঞ্চম শ্রেণিতে শতভাগ পাস ও বৃত্তি পেতে থাকে শিক্ষার্থীরা। সরকারি অনুদানের অর্থের অভাবে উন্নয়নমূলক কাজ আটকে যায়। শহিদুল নিজের সম্পত্তি বেচে ও বেতনের সিংহভাগ টাকা দিয়ে সেই কাজ চালিয়ে যান। এ পর্যন্ত তাঁর সাড়ে ১৪ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে, জানালেন এই শিক্ষক। ধীরে ধীরে পড়াশোনার মান বাড়তে থাকে। ২০০৫ সালে বিদ্যালয়টি উপজেলায় সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
২০০৬, ২০১২ ও ২০১৬ সালে জেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন শহিদুল। ২০১৯ সালে ঢাকা বিভাগে ও সারা দেশে সেরা প্রধান শিক্ষক হন। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় ২০১৭, ২০২২ ও ২০২৪ সালে জেলার শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্বাচিত হয় স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২০২৪ সালে ঢাকা বিভাগের শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায়।
সততা স্টোর
স্কুলে এসে অনেক শিক্ষার্থী খাতা–কলম কেনার জন্য দোকানে যেত। বিষয়টি যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি পাঠদানে ব্যাঘাত ঘটে। এই সমস্যা দূর করতে ও শিক্ষার্থীদের সততার শিক্ষা দিতে ২০১৫ সালে শহিদুল চালু করেন বিক্রেতা ছাড়া দোকান। বিদ্যালয়ে একটি স্থানে শিক্ষা উপকরণ রাখা হতো। বিভিন্ন পণ্যের গায়ে দাম লেখা থাকত। আর শিক্ষার্থীরা এসে দাম পরিশোধ করে পণ্য নিয়ে যেত। সুনাগরিক হিসেবে শিক্ষার্থীদের গড়ার লক্ষ্যে শহিদুল এই উদ্যোগের নাম দেন ‘সততা স্টোর’।
এ নিয়ে ২০১৬ সালের জুনে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ২০১৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে সারা দেশে সততা স্টোর চালু করে।
তৎকালীন রাজবাড়ী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ছিলেন মো. তৌহিদুল ইসলাম; বর্তমানে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক। তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শহিদুল ইসলাম যখন বিদ্যালয়ে ‘সততা স্টোর’ চালু করেন, তখন দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে।
‘বন্ধু টিম’
স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চারপাশের তিনটি গ্রামের শিক্ষার্থীরা এখানে পড়ে। গ্রামগুলোকে কয়েকটি পাড়ায় বিভক্ত করে শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রধান শিক্ষক ‘বন্ধু টিম’ গঠন করে দিয়েছেন। বন্ধু টিমের সদস্যরা প্রতিদিন একসঙ্গে বিদ্যালয়ে আসে, একত্রেই ফেরে। বন্ধুদের পড়াশোনায় একে অন্যকে সহায়তা করে। প্রত্যেক দলে একজন করে দলনেতা থাকে। দলের কেউ বিদ্যালয়ে আসতে না পারলে দলনেতা শিক্ষকের কাছে জানায়। প্রয়োজনে দলের সদস্যরা কিংবা শিক্ষক নিজে গিয়ে শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসেন।
বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়ানো, শিক্ষার্থী ঝরে পড়া ঠেকাতে, নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশে, সহযোগিতার মনোভাব তৈরিতে বন্ধু টিম বেশ কার্যকর। ২০২৪ সালের শুরু থেকে এ কার্যক্রম শুরু করেন শহিদুল। এই উদ্ভাবন ও বিদ্যায়তনে আদর্শিক চর্চার জন্য স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শিক্ষক শহিদুলকে সম্মাননা জানানো হয়। গত বছরের ২৪ অক্টোবর নায়েম (ন্যাশনাল একাডেমি ফর এডুকেশনাল ম্যানেজমেন্ট) ও ইউনেসকো যৌথভাবে এই সম্মাননা দেয়।
রাজবাড়ী সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক ও সাবেক জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আজিজা খানম প্রথম আলোকে বলেন, শহিদুল ইসলাম একজন নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। স্কুলটাই যেন তাঁর প্রাণ। তাঁকে শুধু আদর্শ শিক্ষক বললে কম বলা হবে। তিনি নিজেই কাজ করেন, ব্যক্তিগতভাবে অনেক টাকাও দিয়েছেন।
সরেজমিনে একদিন
রাজবাড়ী-বালিয়াকান্দি আঞ্চলিক পাকা সড়ক ঘেঁষে ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদ। সামনে ইটের রাস্তাসংলগ্ন চারদিক দিয়ে পাকা প্রাচীরে ঘেরা বিদ্যালয়। ২ জানুয়ারি সরেজমিনে দেখা যায়, ভেতরে তিনটি একতলা ভবন। রয়েছে শিশুবান্ধব মীনা ও রাজু পার্ক, ফুলের বাগান, শহীদ মিনার, পশুপাখির ম্যুরাল, সততা স্টোর, শাপলা স্কয়ার ও ছাদবাগান। ৫৪ শতাংশ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত স্কুলটিতে শিক্ষার্থী আছে ৪৭০ জন, শিক্ষক ১০ জন।
পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী আইরিন জান্নাত বলে, এখানকার শিক্ষকেরা অনেক ভালো। যত্ন করে পড়ান।
বিদ্যালয় থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে আনন্দবাজার এলাকা থেকে নাতি ঈশান মোল্লাকে নিয়ে এসেছেন নানা চয়ন মোল্লা। তিনি বলেন, প্রধান শিক্ষকের দক্ষতার কারণে এই বিদ্যালয়ের নামডাক শুনেছেন। এ জন্য নাতিকে ভর্তি করতে নিয়ে এসেছেন।
দেশসেরা হওয়ার স্বপ্ন
শহিদুল ইসলামের বাড়ি বালিয়াকান্দির ইসলামপুর ইউনিয়নে বাড়াদি গ্রামে। সংসারে তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলে। বড় ছেলে ওয়ালিদ হাসান (২১) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরি সায়েন্সে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন। ছোট ছেলে খালিদ হাসান স্থানীয় বহরপুর উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।
তাঁর স্ত্রী কাকলী ইসলাম বলেন, সকাল থেকে প্রায় দিনই অনেক রাত পর্যন্ত উনি স্কুলেই থাকেন। ভালো লাগে যখন তাঁকে নিয়ে মানুষজন ভালো বলে।
আর শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের নানা প্রান্ত থেকে অনেকে স্কুল দেখতে আসেন। এটা আমাদের জন্য গর্বের। আমার আশা, একদিন দেশসেরা হবে এই বিদ্যালয়।’