টাঙ্গুয়ার হাওরে নীলাদ্রির কাছে চোখজুড়ানো ‘নীলিমা’

পাহাড়ি ঝরনা নীলিমা। নীলাদ্রি লেকের বেশ কাছেই এর অবস্থান হলেও মানুষের কাছে তেমন পরিচিত নয়
ছবি: প্রথম আলো

হাওরে বজরায় রাত কাটিয়েছি। বিকেলে টাঙ্গুয়ার হাওরের জলে দাপাদাপিতে কিছুটা ক্লান্ত ছিলাম। তারপরও রাতে নৌকায় বসে গানবাজনা করেছি সবাই। দিনের গরমের রেশ ছিল রাতেও। তবে মধ্যরাতের হালকা বৃষ্টিতে শরীর জুড়িয়েছে। ঘুমটাও ভালো হয়েছে।

সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে দিনভর ঘোরাঘুরির পর যেসব পর্যটক রাত যাপন করেন, তাঁদের নিয়ে নৌকা, হাউসবোটগুলো সন্ধ্যার পরপর আস্তানা গাড়ে হাওরের উত্তর পাড়ে টেকেরঘাট এলাকায়। টেকেরঘাটের অবস্থান ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। পাহাড়ের সবুজে চোখ জুড়ায়, মনে প্রশান্তি এনে দেয়।

রাতের আড্ডা শেষে ঘুমের দেশে যাওয়ার আগে সংক্ষিপ্ত বৈঠকে বসেন সবাই। উদ্দেশ্য, সকালের ভ্রমণপথ নির্ধারণ। সিদ্ধান্ত হলো, সকাল সাতটায় আমরা বের হব। কিছু সময় কাটাব পাশের নীল জলের শহীদ সিরাজ লেকে (নীলাদ্রি)। এরপর সবুজ বনের বারিকের টিলা, দৃষ্টিনন্দন শিমুলবাগান, রূপের নদ জাদুকাটা হয়ে আবার ফিরব নৌকায়। নাশতা সেরে নৌকা ছুটবে টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ারে। সেখানে গোসল হবে, সাঁতার হবে। দুপুরের খাবার খেয়ে বিকেলে তাহিরপুর উপজেলা সদরে। বৈঠক শেষ হতে না হতেই হালকা ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করল।

আমাদের আশপাশে পর্যটকবাহী অসংখ্য নৌকা, হাউসবোট জলের ওপর ভাসছে। কোনোটির ছাদে গান গাইছেন পর্যটকেরা। কোনোটিতে গল্প-আড্ডা, আবার কেউবা নীরবে তাকিয়ে আছেন উত্তরের পাহাড়ের দিকে। এর মধ্যেই শুরু হলো বৃষ্টি। মধ্যরাতের এই বৃষ্টি সারা দিনের ভ্যাপসা গরমের রেশ কাটিয়ে স্বস্তি ফিরিয়ে দিল। একসময় বৃষ্টি থামল। পাহাড়ে অসংখ্য বাতি জ্বলছে। কী পরিষ্কার লাগছে সবকিছু! যেন বৃষ্টি ধুয়ে দিয়েছে পাহাড়কে। হাওরের জলে মৃদুমন্দ বাতাসে খেলা করছে ছোট ছোট ঢেউ।

আরও পড়ুন

সাতসকালে নৌকার মাঝিরা আমাদের ঘুম ভাঙান। ‘মোটরবাইক তো রেডি’ বলে ডাকাডাকি মাঝি মিঠুর। কিন্তু মোটরসাইকেলে ওঠার আগমুহূর্তে এক চালকের কথায় রাতের সব পরিকল্পনা বাতিল। ওই চালকের কথা হলো, ‘আপনারা নয়া একটা পাহাড়ি ঝরনা দেখুইন। ইটার খবর মানুষে বেশি জানে না, খুব সুন্দর...।’ সঙ্গী মাহবুবুল হাসান জানতে চান, কী নাম এটার। চালকের উত্তর, ‘নীলিমা’। আমরা তখন নীলাদ্রির পাশে। আর নীলিমা নাকি এখান থেকে মিনিট বিশেকের দূরত্বে।

আমাদের আরেক সঙ্গী দাউদের কথা হলো, সুন্দরী নীলিমার সন্ধান যখন পেয়েই গেছি, তখন একনজর দেখে না যাওয়া ঠিক হবে না। তাঁর কথায় সায় দেন অন্যরাও। মোটরসাইকেল ছোটে আমাদের ১১ জনের দল নিয়ে। আমরা সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে ছুটছি নীলিমার কাছে। পাহাড়ের পাদদেশের রাস্তাটা বড়ই খারাপ। কাঁচা-পাকার সঙ্গে দুয়েকটি স্থানে একেবারে ভাঙাও পাওয়া গেল। কাদাপানি মাড়িয়ে আমরা এক গ্রামে গিয়ে থামলাম। তখনো গ্রামের মানুষদের অনেকেই ঘুমে। সীমান্তঘেঁষা এই গ্রামের নাম লালঘাট। কিন্তু লালঘাটে তো লালের চিহ্ন নেই, চারদিকে সবুজ।

নীলিমা ঝরনার জলের ধারা ছোট-বড় পাথরের ওপর দিয়ে লালঘাট গ্রামের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে গিয়ে মিশেছে হাওরে
ছবি: প্রথম আলো

সমতল থেকে খানিকটা উঁচু টিলার ওপর গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে আমরা পৌঁছালাম মেঘালয় পাহাড়ের পায়ের কাছে। সেখান থেকে ইচ্ছা করলে ছোঁয়া যায় সীমান্তের কাঁটাতার। আমরা যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, সেটা আসলে সীমান্তের শূন্যরেখা (নো ম্যানস ল্যান্ড)। মেঘালয় পাহাড় থেকে এসেছে স্বচ্ছ পানির একটি ধারা। এই জলের ধারা ছোট-বড় পাথরের ওপর দিয়ে, কোথাও পাশ দিয়ে নেমে লালঘাট গ্রামের মধ্য দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে গিয়ে মিশেছে হাওরে। জায়গাটা দেখে মনে হলো, সবুজ শাড়ির আঁচলে প্রকৃতি এলাকাটাকে ঢেকে রেখেছে। তাই সুন্দরী নীলিমার খোঁজ এখনো অনেকেই জানে না।

‘জায়গাটা দারুণ। মনে হয়, গহিন বনের ভেতরে লুকিয়ে আছে সুন্দরী পাহাড়ি এই ঝরনা। না এলে মিস করতাম।’ এ আর জুয়েলের কথায় কিছুটা আফসোস। বহুবার টাঙ্গুয়ার হাওর, পাশের নীলাদ্রি লেকে এসেছি। ঘুরে গেছি এখান থেকে মিনিট দশেকের পথ লাকমাছড়া। কিন্তু এই ঝরনার কথা কেউ এত দিন কেন বলেনি!

ঝরনার নাম ‘নীলিমা’ কেন? প্রশ্ন ছিল লালঘাট গ্রামের তরুণ শমসের আলীর কাছে। ‘নীলাদ্রি তো পাশেই, এটা ওইটার ছোট বোন নীলিমা। এলাকার লোকজনই এই নাম দিছে’, শমসের বলেন, লাকমাছড়া থেকে এখানে আসতে রাস্তাটা বেশ খারাপ। গত বছরের বন্যায় আরও বেশি খারাপ হয়েছে। তাই মোটরসাইকেলচালকেরা এখানে লোকজনকে নিয়ে আসতে চান না। নীলিমা সে কারণে মানুষের কাছে সেভাবে পরিচিতি পায়নি।

আরও পড়ুন

একসময় এই ঝরনা দিয়ে ওপর থেকে সরাসরি পানি নেমে যেত হাওরে। কয়েক বছর আগে সীমান্তের ওপারে চলাচলের জন্য রাস্তা করা হয়েছে। এ কারণে ঝরনার ওপর কয়েকটি পাইপ বসিয়ে ওপরে পাকা করে দেওয়া হয়েছে।

রোদের তেজ বাড়ছে। আমরা টাঙ্গুয়ার হাওরে আবার নৌকা ভাসাব। যাঁরা টাঙ্গুয়ার হাওর, টেকেরঘাটের নীলাদ্রি লেক, লাকমাছড়া ঘুরতে আসেন, তাঁরা ইচ্ছা করলেই পাহাড়ি ঝরনা নীলিমায় ঢুঁ মারতে পারেন। শরীরটা ভেজাতে পারেন নীলিমার ঠান্ডা জলে। এতে মনপ্রাণ সতেজ হবে।