মাঠে নেই সাদিক, ‘নির্ভার’ জাহিদের দুশ্চিন্তা বাড়াতে পারেন ‘অচেনা’ সালাহউদ্দিন

সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ,সালাহউদ্দিন রিপন, জাহিদ ফারুক

বরিশালের রূপাতলী এলাকার একটি চায়ের দোকানে চা পান করছিলেন কয়েকজন ব্যক্তি। শীতের সকালে চায়ের আড্ডায় তাঁদের আলোচ্য বিষয় ছিল নির্বাচন। পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি বলছিলেন, ‘মনে অইলহে ভোটে কনটেস্ট না অইলেও এইবারের প্রচারে মাঠ খুব গরম থাকপে। কিন্তু আচুক্কা মাঠটা ক্যামন ঠান্ডা অইয়্যা গ্যালো।’ তাঁর কথার জবাবে চায়ের কাপ থেকে মুখ তুলে আরেকজন বললেন, ‘এহন ক্যামন কি অইবে আনে? গরম প্রার্থীই তো মাঠে নাই।’ তখন ওই ব্যক্তি বললেন, ‘অইবে আনে, রাহ (রাখ)। ট্রাক আছে না!’

বরিশাল-৫ (সদর-মহানগর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর প্রার্থিতা হারানোর পর সাধারণ ভোটারদের মধ্যে সর্বত্র এমন আলোচনা চলছে। দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করার পরপরই সাদিক আবদুল্লাহর পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয় মহানগর আওয়ামী লীগ। এমন পরিস্থিতিতে দলীয় প্রার্থী পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক ও সাদিক আবদুল্লাহর মধ্যে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার আশা করেছিলেন নগরবাসী। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ শেষ হয়ে যাওয়ায় এখন অনেকটাই ‘নির্ভার’ জাহিদ ফারুক।

সাদিকের প্রার্থিতা বাতিলের পর আলোচনায় উঠে আসছে সালাহউদ্দিন রিপনের নাম। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ট্রাক প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন। বরিশালের রাজনীতিতে সক্রিয় না হলেও সাদিকের ঘনিষ্ঠ হিসেবেই পরিচিত। ঢাকায় ব্যবসা করেন। সাদিকের প্রার্থিতা বাতিলের পর প্রচার-প্রচারণার গতি বাড়িয়েছেন সালাহউদ্দিন। এমনকি প্রার্থিতা ফিরে পেতে সাদিক যখন আইনি লড়াই করছিলেন, তখন সালাহউদ্দিনকেও তাঁর পাশে দেখা গিয়েছিল। আপিল বিভাগে সাদিকের প্রার্থিতা চূড়ান্তভাবে বাতিল হওয়ার পর সালাহউদ্দিন আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছেন।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, সালাহউদ্দিন হয়তো সাদিকের প্রচ্ছন্ন সমর্থন পাবেন। তাঁদের ভাষ্য, বিএনপি এবার নির্বাচনের মাঠে নেই। সাদিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে ছিটকে পড়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে দুই পক্ষের সহানুভূতি সালাহউদ্দিন টানতে চাইবেন। তা পেলে জাহিদ ফারুকের সঙ্গে তিনি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেও উঠতে পারেন।

বরিশাল-৫ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন সাদিক আবদুল্লাহ। কিন্তু দল বর্তমান সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুককে দলীয় মনোনয়ন দেয়। গত সিটি নির্বাচন ঘিরে বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিভেদ দানা বেঁধেছিল। সেই বিভেদে ঘি ঢালে মহানগর আওয়ামী লীগের সমর্থনে সাদিক আবদুল্লাহ স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু সাদিকের প্রার্থিতায় বাদ সাধেন জাহিদ ফারুক। তিনি নির্বাচন কমিশনে সাদিকের দ্বৈত নাগরিকত্ব ও সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগ করলে সাদিকের প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায়। উচ্চ আদালতে আপিল করেও প্রার্থিতা ফিরে পাননি সাদিক। এরপর আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করেছিলেন। কিন্তু মঙ্গলবার সেই আপিলও খারিজ হয়ে যায়।

সাদিকের প্রার্থিতা বাতিল হওয়ার পর হতাশ ও ক্ষুব্ধ হন তাঁর সমর্থকেরা। এখন নগরের ভোটার ও রাজনৈতিক মহলে আলোচনা একটাই—সাদিক আবদুল্লাহ ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এখন কার পক্ষে নির্বাচন করবেন। সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করব না, প্লিজ।’ দলীয় প্রার্থীর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘এ ব্যাপারেও কোনো কথা বলতে চাই না।’

জাহিদ ফারুকের ঘনিষ্ঠ মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আমিন উদ্দীন বলেন, বরিশাল-৫ আসনে জাহিদ ফারুক আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার মনোনীত প্রার্থী। সে ক্ষেত্রে দলের নীতি-আদর্শ ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি যাঁরা আস্থাশীল, দলীয় প্রার্থীকে সমর্থন ও জয়ী করতে কাজ করা তাঁদের সাংগঠনিক বাধ্যবাধকতার মধ্যেই পড়ে। এটা না করলে তিনি দলীয় পরিচয় দেওয়ার নৈতিক অধিকার রাখেন না।

স্থানীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহিদ ফারুক ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাহউদ্দিন রিপন দুজনই বিএনপির ভোটারদের কাছে টানার চেষ্টা করছেন। দুই প্রার্থীর পক্ষে ভোটের প্রচারে নামায় মঙ্গলবার সদর উপজেলার একজন ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পর্যায়ের চার নেতাকে আজীবন বহিষ্কার করেছে বিএনপি।

জাহিদ ফারুকের ঘনিষ্ঠ সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জাহিদ ফারুক সজ্জন ব্যক্তি। এলাকার উন্নয়নে গত পাঁচ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছেন। দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির অভিযোগ না থাকায় মানুষ তাঁর প্রতি আস্থাশীল। এ ছাড়া প্রতিহিংসার রাজনীতি করেন না বলে মানুষের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা আছে। অন্যদিকে সালাহউদ্দিনের এলাকায় পরিচিতি নেই। টাকা দিয়ে কিছুটা মাঠ গরম করা সম্ভব হলেও ভোট নেওয়া যায় না। তাঁর (সালাহউদ্দিন) পেছনে যারাই থাকুক, জাহিদ ফারুক বিপুল ভোটে জয়ী হবেন।

তবে সালাহউদ্দিনের সমর্থকেরা বলছেন, সালাহউদ্দিন দীর্ঘদিন সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের নারী-পুরুষকে তাঁর বেসরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নানা সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তাঁর বড় একটি ভোটব্যাংক তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি সাদিক আবদুল্লাহ ও বিএনপির সমর্থক ভোটারদেরও তিনি সমর্থন পাবেন।

সালাহউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, এবারের নির্বাচনে বরিশালের সাধারণ ভোটাররা তাঁকে বিপুল ভোটে জয়ী করবেন বলে তিনি আশা করছেন। এটা বুঝতে পেরে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর লোকজন তাঁর প্রচারে বাধা দিচ্ছে। কর্মী-সমর্থকদের হুমকি, মারধর ও ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। সুষ্ঠু ভোট হলে তিনি জয়ী হবেন। অভিযোগের বিষয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আমিন উদ্দীন বলেন, এলাকায় তাঁর (সালাহউদ্দিন) গ্রহণযোগ্যতা একেবারেই নেই। নিজের গুরুত্ব বাড়াতে উল্টাপাল্টা অভিযোগ করে ভোটের মাঠে তিনি নিজের গুরুত্ব বাড়াতে চাইছেন।