সরেজমিন
সিলেটে পাথরের পর টিলাও সাবাড়
নগর ও জেলার ৩৪টি স্থানে টিলা কাটার চিহ্ন। এসব টিলার প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন, অন্যগুলো সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত।
কাঁচা–পাকা রাস্তা মাড়িয়ে শেষ মাথায় সুউচ্চ এক টিলার দেখা মেলে। চূড়া সবুজ গাছগাছালিতে ভরা। পাদদেশে টিনশেডের কয়েকটি ঘর। কাছে গেলে টিলা কাটার চিহ্ন স্পষ্ট হয়। সদ্য কাটা টিলার লাল মাটি বেরিয়ে আছে। তবে ঘরগুলো আড়াল তৈরি করায় টিলার পাদদেশে কী হচ্ছে, সেটা দূর থেকে বোঝার সুযোগ নেই।
এ দৃশ্য সিলেট শহরতলির খাদিমপাড়া ছড়ারপাড় এলাকার। গত সোমবার সন্ধ্যায় আড়াল তৈরি করা একটি ঘরের পেছনে গিয়ে দেখা গেল, একটি ট্রাক্টর-ট্রলি দাঁড়ানো। দুজন শ্রমিক বেলচা, কোদাল দিয়ে টিলার মাটি কেটে ট্রাক্টরে রাখছেন। বোঝাই শেষে চালক ট্রলি নিয়ে চলে যান। পরে আরেকটি ট্রাক্টর এলে একইভাবে বোঝাই করা হয়।
এভাবে শুধু ছড়ারপাড় এলাকার টিলা নয়, নগর ও জেলার ৯টি স্থানে প্রকাশ্যে টিলা কেটে সমতল করার দৃশ্য দেখা গেছে। গত সোম ও মঙ্গলবার টানা দুই দিন সরেজমিন ঘুরে এর বাইরে আরও অন্তত ২৫টি জায়গায় টিলা কাটার চিহ্ন পাওয়া যায়। এসব টিলার প্রায় ৭০ শতাংশই ব্যক্তিমালিকানাধীন, অন্যগুলো সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ৬ (খ) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরকারি বা আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করতে পারবে না।
পাথর লুটের পর সিলেটে টিলাও দেদার কাটা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সিলেটের সদস্যসচিব আবদুল করিম চৌধুরী (কিম)। তিনি বলেন, অতীতে এক বছরে যে পরিমাণ টিলা কাটা হয়েছে, গত এক বছরে এর কয়েক গুণ বেশি কাটা হয়েছে। আগে রাতে চুপিসারে টিলা কাটা হতো। এখন দিনের বেলা প্রকাশ্যে চলছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন নীরব।
এভাবে শুধু ছড়ারপাড় এলাকার টিলা নয়, নগর ও জেলার ৯টি স্থানে প্রকাশ্যে টিলা কেটে সমতল করার দৃশ্য দেখা গেছে। গত সোম ও মঙ্গলবার টানা দুই দিন সরেজমিন ঘুরে এর বাইরে আরও অন্তত ২৫টি জায়গায় টিলা কাটার চিহ্ন পাওয়া যায়। এসব টিলার প্রায় ৭০ শতাংশই ব্যক্তিমালিকানাধীন, অন্যগুলো সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত।
প্রকাশ্যে টিলা সাবাড়
সবচেয়ে বেশি টিলা কাটা হচ্ছে সদর উপজেলার খাদিমপাড়া ইউনিয়নে। এখানে শতাধিক ছোট-বড় টিলার অবস্থান। সোমবার দুপুর ও সন্ধ্যায় সরেজমিনে দেখা যায়, এই ইউনিয়নের উত্তর মোকামের গুল, মোকামের গুল, টিকরপাড়া, হজরত শাহ সুন্দর মাজার রোড, পিরেরচক, ছড়াগাং চা-বাগান, ছড়ারপাড় ও গোল্লা এলাকায় ১০টি টিলা কাটা হচ্ছে। এর বাইরে খুনিরচক, দাসপাড়া, চকগ্রাম, দলইপাড়া, মলাই টিলা, জালালনগরসহ অন্তত ১৫টি এলাকায় টিলা কাটা চলছে বলছে স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেছেন।
অতীতে এক বছরে যে পরিমাণ টিলা কাটা হয়েছে, গত এক বছরে এর কয়েক গুণ বেশি কাটা হয়েছে। আগে রাতে চুপিসারে টিলা কাটা হতো। এখন দিনের বেলা প্রকাশ্যে চলছে।
খাদিমপাড়া ইউনিয়নের একজন বাসিন্দা বলেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন টিলা কেটে সমতল করে মাটি অপসারণ করতে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্রকে নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে মালিকেরা নিয়োগ দেন।
শাহ সুন্দর মোকামের গুল জামে মসজিদের বিপরীতে সুবিশাল একটি টিলা আছে। স্থানীয় লোকজন জানান, এটি ‘মামা খন্দকারের টিলা’ হিসেবে পরিচিত। এর আয়তন প্রায় দেড় একর। একসময় টিলাটি গাছে পরিপূর্ণ ছিল। কয়েক মাস আগে দৃষ্টিনন্দন টিলাটি কেটে অনেকটাই সাবাড় করে ফেলা হয়েছে। দেড় মাস ধরে টিলা কাটা বন্ধ আছে। তবে টিলার চূড়া কেটে অসংখ্য নালা তৈরি করে রাখায় বৃষ্টি হলেই মাটি পানির সঙ্গে গড়িয়ে ক্ষয় হচ্ছে।
মামা খন্দকারের টিলার স্বত্বাধিকারী খন্দকার আনোয়ার হোসেন। তাঁর মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার কল করলেও তিনি সাড়া দেননি।
এদিকে সোমবার দুপুরে জৈন্তাপুর উপজেলার গৌরী, সারিগুল, বনপাড়া, থুবাং, চান্দঘাট, শিখার খাঁ ও উমনপুর গ্রাম ঘুরে একাধিক স্থানে টিলা কাটার অস্তিত্ব দেখা গেছে। পরদিন মঙ্গলবার দিনভর সিলেট নগরের কারিপাড়া, ব্রাহ্মণশাসন, দুসকি, হাওলাদারপাড়া, নালিয়া, ডলিয়া, আখালিয়া, মোহাম্মদীয়া, গোয়াবাড়ি, বড়গুল, মেজরটিলা এলাকায় টিলা কেটে বসতঘর তৈরির পাশাপাশি সমতল করে রাখার চিত্র দেখা যায়। এর আগে গত ২০ আগস্ট গোয়াইনঘাট উপজেলার রামনগর গ্রামে একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন টিলা কাটতে দেখা গেছে।
স্থানীয় লোকজন জানান, নগরের বাহুবল, ওসমানী মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ গুচ্ছগ্রাম, বহর কলোনি, সিরাজনগর, সবুজনগর, উপজাতি কুলিবস্তি, ফাতেমানগর, জাহানপুর, সৈয়দপুর, চামেলীবাগ, বালুচর এলাকায় টিলা কাটা চলছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন টিলার পাশাপাশি এখানকার বেশির ভাগ টিলা সরকারি খাস খতিয়ানের অন্তর্ভুক্ত।
এ বিষয়ে সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খোশনূর রুবাইয়াৎ বলেন, সরকারি কিংবা ব্যক্তিমালিকানাধীন, কোনো টিলাই কাটা যাবে না। এ বিষয়ে অভিযান চালানোর পাশাপাশি আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, টিলা কেটে ফেলার নেতিবাচক প্রভাব সিলেটে পড়তে শুরু করেছে। এতে ভূমিক্ষয় বাড়ছে। প্রয়োজনের সময় বৃষ্টি না হয়ে অপ্রয়োজনের সময় হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। তাই যেসব টিলা এখনো অক্ষত আছে, সেসবের সুরক্ষা দরকার।
৪৫ শতাংশ টিলা সাবাড়
কী পরিমাণ টিলা সিলেটে ছিল, এর সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান সরকারি কোনো সংস্থার কাছে পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) জানিয়েছে, জেলায় ১ হাজার ২৫টি ছোট-বড় টিলা ছিল। নগর এবং সদর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় থাকা এসব টিলার আয়তন ২৫১ একর। সব উপজেলাতেই কমবেশি টিলা কাটা হচ্ছে।
পরিবেশবাদী একাধিক সংগঠন জানিয়েছে, ২০২৪ সালের আগের আড়াই দশকে সিলেটে অন্তত ৩০ শতাংশ টিলা সাবাড় হয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর প্রশাসন, পুলিশ ও পরিবেশ অধিদপ্তর কয়েক মাস ‘নিষ্ক্রিয়’ ছিল। এ সুযোগে অবাধে টিলা কাটা চলে। এ সময় অন্তত ১৫ শতাংশ টিলার মাটি কমবেশি সাবাড় হয়। ২০২৪ সালের আগে-পরে ৪৫ শতাংশ টিলা পুরোপুরি বা আংশিক সাবাড় হয়েছে।
সিলেটের প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। টিলা কাটায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শিগগিরই অভিযান চালানো হবে।জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম
বেলা সিলেটের বিভাগীয় সমন্বয়কারী শাহ সাহেদা আক্তার বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে খুবই দ্রুতগতিতে বেড়েছে টিলা ধ্বংসের কর্মকাণ্ড। এর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
বেলা সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ থেকে এ পর্যন্ত সিলেট জেলায় টিলা ধসে নিহত হন ১৫ জন। আহত হন অর্ধশতাধিক। এ ছাড়া টিলার পাদদেশে আধা পাকা ও কাঁচা বাড়ি করে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ১০–১৫ হাজার পরিবার বসবাস করছে বলে জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, টিলা কেটে ফেলার নেতিবাচক প্রভাব সিলেটে পড়তে শুরু করেছে। এতে ভূমিক্ষয় বাড়ছে। প্রয়োজনের সময় বৃষ্টি না হয়ে অপ্রয়োজনের সময় হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। তাই যেসব টিলা এখনো অক্ষত আছে, সেসবের সুরক্ষা দরকার।
কারা কাটছেন টিলা
পরিবেশবাদীরা জানান, আড়াই দশক ধরে সিলেটে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি প্রভাবশালী ব্যক্তি, আবাসন ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে টিলা কাটার বিস্তর অভিযোগ আছে। তবে কারা এই টিলা কাটছেন, সেটা প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে স্থানীয় লোকজনের কেউ বলতে সাহস পান না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কিছু মামলা ঘেঁটে টিলা কাটার সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যক্তির নাম ও পরিচয় জানা যায়। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, গত ২৯ এপ্রিল সদর উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর গ্রামে টিলা কাটার অভিযোগে ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এতে সদর উপজেলা বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক খান, সিলেট মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক আজিজ খান সজীব ও টুকেরবাজার ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. হাফিজুর রহমানকে আসামি করা হয়।
মামলা দায়েরের পরদিন ৩০ এপ্রিল অভিযুক্ত আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তিনি টিলা কাটার বিষয়টি অস্বীকার করে দাবি করেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কেউ টিলা কাটায় জড়িত নন। সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে মামলা হয়েছে।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, টিলা কেটে ফেলার নেতিবাচক প্রভাব সিলেটে পড়তে শুরু করেছে। এতে ভূমিক্ষয় বাড়ছে। প্রয়োজনের সময় বৃষ্টি না হয়ে অপ্রয়োজনের সময় হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। তাই যেসব টিলা এখনো অক্ষত আছে, সেসবের সুরক্ষা দরকার।
এদিকে গত ২৬ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার শাহ আরেফিন টিলা কাটার ঘটনায় ৪০ জনকে আসামি করে মামলা করেছে। মামলায় কাঁঠালবাড়ি গ্রামের বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে প্রধান আসামি করা হয়। এ ছাড়া মনির মিয়া, আবদুল করিম, আবদুর রশিদ, আইয়ুব আলী, আঞ্জু মিয়া, সোহরাব আলী, তৈয়ব আলী, বতুল্লাহ মিয়া প্রমুখকে আসামি করা হয়। তাঁরা বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক হিসেবে পরিচিত। তবে দলে কোনো পদপদবি নেই।
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার জানান, গত বছরের ৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে টিলা কাটার পরিমাণ কিছুটা বেড়েছিল। তবে অভিযান, মামলা দায়েরসহ নানা পদক্ষেপের কারণে এখন আগের চেয়ে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়েছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, সিলেটের প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। টিলা কাটায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শিগগিরই অভিযান চালানো হবে।