কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের খেওয়ার আলগার চরের বাসিন্দা মোন্নাফ আলী (৩৮) ও পিঞ্জিরা বেগম (৩০) দম্পতি। ১০ বছরের সংসারজীবনে তাঁরা নদীভাঙনের শিকার হয়েছেন চারবার। সর্বশেষ ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে পোড়ার চর থেকে ভিটে হারিয়ে আট মাস আগে খেওয়ার আলগার চরে আসেন। এ চরে নদীভাঙনের ঝুঁকি কিছুটা কম, কিন্তু নিচু চর হওয়ায় দফায় দফায় বন্যার কবলে পড়েছেন এই দম্পতি।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে আলাপকালে পিঞ্জিরা বেগম বলেন, ‘দেড় মাস থাকি, দফায় দফায় বন্যা আসে আর যায়। রোববার রাতে উজানের পানি আসি ঘরত উঠছে। পাঁচ দিন থাকি ঘরত থাকার উপায় নাই। এল্যা গরু মানুষ একসঙ্গে আছি।’
মোন্নাফ আলী বলেন, ‘বাড়িতে বর্গা নেওয়া দুটি গরু আছে, এনজিওর কাছ থিকি ঋণের ট্যাকায় কেনা কয়ড়া ছাগল-ভেড়া আছে। বাড়িত ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। বানের দিনত বেডি ছাওয়া (স্ত্রী) মানুষের ভরসায় গরু–ছাগল থুইয়ে কামেও যাবার পারি নাই। জমানো টাকাপয়সা সব শ্যাষ। ধারদেনা করি কোনোমতে চলবের নাগছি। এল্যাও ত্রাণ পাই নাই।’
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে এক সপ্তাহ থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাড়তে শুরু করেছে। তিস্তা নদীর পানি কমলেও এখনো বিপৎসীমার ওপরে রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম না করলেও সমতলে বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতেই মোন্নাফ–পিঞ্জিরা দম্পতির ঘরে পানি উঠেছে। একই অবস্থা একই চরের হাজরা বেওয়া (৬০), ইনছান আলীসহ অনেকের। ইনছান আলী স্ত্রী-সন্তানদের যাত্রাপুরে আত্মীয় বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি একা নৌকায় থেকে বাড়ি পাহারা দেন। হাজরা বেওয়া এসে উঠেছেন প্রতিবেশী মাসুদের দোকানঘরে।
হাজরা বেওয়া বলেন, ‘চার দিন থাইক্যা ঘরে পানি, পানির কল ও টয়লেট বানের পানিতে ডুবি আছে। প্রসাব-পায়খানা করা খুব কঠিন হয়া গেইছে।’
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল গফুর সরকার প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ দিন থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সমতলে বৃদ্ধি পেয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে তাঁর ইউনিয়নের চরাঞ্চলের পাঁচ শতাধিক বসতবাড়িতে পানি উঠেছে এবং দেড় হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এ বছরে এটা ব্রহ্মপুত্রে তৃতীয় দফায় বন্যা। কিন্তু এখনো কোনো ত্রাণ পাননি। আজ ব্রহ্মপুত্র চরাঞ্চল ঘুরে মানুষের দুর্দশার কথা ইউএনওকে জানিয়েছেন। তিনি ত্রাণের ব্যবস্থা করতে চেয়েছেন।
গতকাল বুধবার প্লাবিত এলাকাঘুরে এবং আজ বৃহস্পতিবার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ারচর, গোয়ালপুরী, ঝুনকারচর, মাঝিয়ালীরচর, বারোবিষ, চর ভগবতীপুর ও খাসের চরের দেড় হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মশালেরচর, বতুয়াতলী, দক্ষিণ বালাডোবা, উত্তর বালাডোবা, রসুলপুর চরসহ বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে তিন হাজার পরিবার পানিবন্দী। সাহেবের আলগা ইউনিয়নের মাঝের আলগা, ২৭ দাগের চর, মেকুরের আলগা, পূর্ব দইখাওয়া নামাপাড়া, আইরমারীর চর, নামাজের চর, সুখের বাতির নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে তিন শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। চিলমারী উপজেলার নয়ারচর ইউনিয়ন, চিলমারী সদর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের চরে পানি উঠে সাত শতাধিক পরিবারের বসতবাড়ি হয়েছে প্লাবিত।
উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া বলেন, তাঁর ইউনিয়নের প্রায় তিন হাজার পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় আছে। ইতিমধ্যে দুই শতাধিক পরিবারের বসতভিটা প্লাবিত হয়েছে। তিনি দুই মেট্রিক টন করে চাল দুই দফায় পেয়েছেন। উপজেলার সবচেয়ে নিচু এলাকা বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন। এখানে মানুষ প্রতিবছর বন্যা ও নদীভাঙনের শিকার হয়ে অভাবের মধ্যে বসবাস করে। তাদের জন্য একটু বরাদ্দ বেশি দেওয়া দরকার।
উজানের ঢলে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সমতলে বাড়ছে বলে জানিয়েছেন পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, তিস্তা নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার এক সেন্টিমিটার ওপরে রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র ছাড়া জেলার অন্যান্য নদ-নদীর পানি কমছে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সমতলে বৃদ্ধি পেয়ে চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় বড় কোনো বন্যার আশঙ্কা নেই।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ প্রথম আলোকে জানান, বন্যার্ত মানুষের সহযোগিতার জন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে যথেষ্ট বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ৯৬ দশমিক ৫ মেট্রিক টন চাল, নগদ ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং শুকনো খাবার রাখা আছে। বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য ১৮টি স্থায়ী ও ৩৬১টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।